শুভঙ্কর বসু: জল পাই কোথায়! করোনা ভাইরাসের দাপটে সুকুমার রায়ের অবাক জলপান কবিতার এই বিখ্যাত লাইনটিই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে কয়েক কোটি দেশবাসীর মনে। না, পান করার জন্য নয়। শুখা মরশুম পড়তেই হাত ধোয়ার জলের চিন্তায় ঘুম উড়েছে তাঁদের। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি বারবার হাত ধোয়ার নিদান দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রিসার্চের মতো সংস্থা। বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী, এই মারণ ভাইরাস তাড়াতে পরিশ্রুত জলে সাবান বা লিকুইড সোপ জাতীয় জিনিস দিয়ে অন্তত কুড়ি সেকেন্ড হাতের এপিঠ ওপিঠ কচলে ধুতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, দেশের ৬৭ শতাংশ অংশে যেখানে ঠিকমতো খাওয়ার জলই জোটে না সেখানে হাত ধোয়ার জল মিলবে কী করে?
বিশেষজ্ঞদের এই পরামর্শ মানতে গেলে হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবার হাত ধোয়ার জন্য প্রয়োজন অন্তত এক লিটার জল। সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন হাত ধুতেই একজনের গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ লিটার জল লাগার কথা। সেই হিসাবে প্রতিটি পরিবারের হাত ধোয়া পিছু প্রতিদিন প্রয়োজন অন্তত ৫০ থেকে ৬০ লিটার পরিস্রুত জল। ফলে উপায় কি? ন্যাশনাল রুরাল ওয়াটার ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রামের রিপোর্ট অনুযায়ী, শুখা মরসুমে দেশে অন্তত ৭৯ কোটি মানুষ জল কষ্টে ভোগেন। গ্রামাঞ্চলের অন্তত ৭৮ শতাংশ মানুষের স্থায়ী কোনও জলের উৎস নেই। জল সংগ্রহ করতে অনেককে ২ থেকে ৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। এছাড়াও শহরাঞ্চলে অন্তত ৫৯ শতাংশ মানুষের পাকাপাকি জলের ব্যবস্থা নেই। বসতি ও ঘিঞ্জি এলাকাগুলিতে গুটি কতক ট্যাপ কলই ভরসা। জল সংগ্রহ করতে হয় রীতিমতো লাইন দিয়ে।
পাশাপাশি, দেশের ৭০ শতাংশ জলাশয়ই দূষিত। তাছাড়া পানীয় জল নিয়ে করা ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসের (এনএসএসও) ৭৬তম রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে মাত্র ২১.৪ শতাংশ বাড়িতে সরাসরি পাইপের মাধ্যমে জল পৌঁছয়। জল সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের তথ্য বলছে, ২০১১-র নিরিখে দেশে বার্ষিক জলের মজুতের পরিমাণ কমেছে ২০৪ কিউবিক মিটার। প্রতিবছর দেশে জলস্তর কমছে হু হু করে। উষ্ণায়ন বাড়ার সাথে সাথে তা আরও কমবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।এখন বারবার হাত ধোয়ার নিদান কিভাবে মানা সম্ভব তা নিয়ে ধন্দে পড়েছেন বিশেষজ্ঞরাই। তার উপর আবার সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জলে করোনার উপস্থিতি উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। ফলে শুধু জল হলেই চলবে না। হাত ধোয়ার জন্য চাই পরিশ্রুত জল। এছাড়াও করোনার দাপট আর কতদিন চলবে তা নিয়ে এখনই হলফ করে বলা যাচ্ছে না। ফলত অদূর ভবিষ্যতেও হাত ধোয়ার অভ্যাস যে চালিয়ে যেতে হবে তা একরকম নিশ্চিত। তাছাড়া শুধু হাত ধোয়া নয়। মুখে যে মাস্ক বা কাপড় ব্যবহার করতে বলা হয়েছে সেটিও সাবান বা ডিটারজেন্ট দিয়ে বারবার পরিষ্কার করে নিতে বলা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র এবং ওড়িশার মতো জলসংকট জর্জরিত রাজ্যগুলির মানুষের কী হবে? পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমানের মতো জেলাগুলিতে শুখা মরসুমে প্রবল জলের আকাল দেখা দেয়। রাজ্যে অন্তত ৭৮ লক্ষ মানুষ ঠিকমতো পানীয় জল পান না। গ্রামে তো বটেই শুখা মরসুমে শহরাঞ্চলেও জলের জন্য রীতিমতো হত্যে দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। পুরুলিয়ার অন্তত ৮০ শতাংশ এলাকায় খরাপ্রবণ। তাছাড়া রাজ্যের মোট ৩৪১ ব্লকের কমবেশি আর্সেনিক-ফ্লুরাইডে দূষিত। যার মধ্যে ৮৩টি ব্লকের অবস্থা ভয়াবহ। পাশাপাশি রাজ্যে জলস্তর হু হু করে কমছে।
তাহলে উপায় কী? বিশিষ্ট হাইড্রোলজিস্ট প্রদীপ কুমার সেনগুপ্তর কথায়, “এখন ভাইরাস থেকে বাঁচতে হাত যেহেতু বারবার ধুতেই হবে তাই জল বাঁচানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তাছাড়া শুখা অঞ্চলগুলিতে যেখানে জলের প্রচণ্ড ক্রাইসিস সেখানে একটি পাত্রে সাবান বা ডিটারজেন্ট মিশিয়ে রাখতে হবে। প্রতিবার হাত ধোয়ার সময় সেই মিশ্রণে হাত চুবিয়ে কচলে নিতে হবে। এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করলে পরিস্রুত জল কম প্রয়োজন পড়বে। এছাড়াও পুকুর, খাল ও নদীর জল কৃত্রিম উপায়ে পরিশ্রুত করে হাত ধোয়ার জন্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া গেলে কিছুটা হলেও এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।”
লকডাউন এর দ্বিতীয় পর্বে অবশ্য পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ রাজ্যগুলিকে নির্দেশিকা পাঠিয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রক। সংশ্লিষ্ট রাজ্যের শুখা এলাকাগুলিতে নিরবিচ্ছিন্ন জল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি রিলিফ ক্যাম্প, বস্তি, করেন্টিন সেন্টার এবং হাসপাতালগুলিতে জল পরিশ্রুত করতে ক্লোরিন ট্যাবলেট, ব্লিচিং পাউডার সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড সলিউশনের পর্যাপ্ত মজুত রাখতে বলা হয়েছে। তবে মানুষ যদি এখনই সচেতন হয়ে জলের অপচয় বন্ধ না করে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বিপদ আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.