ছবি: সোমনাথ রায়।
সোমনাথ রায়, লে: “স্যর, আমরা এখন আর অত দূর যেতে পারি না, আগে যতখানি পারতাম।” লে শহর (Leh City) থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে রুমসে এলাকার নাম না জানা কোনও এক অজানা প্রান্তরে কথাগুলি বলছিলেন যাযাবর সোনম দোরজি।
একটু আগেই নিমেষে তাঁকে নেমে আসতে দেখলাম প্রায় কয়েক কিলোমিটার উঁচু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। শুধু কি নিজে নেমে এলেন? নামিয়ে আনলেন প্রায় শ’চারেক ভেড়া, মেষ, পশমিনা ছাগল। সোনমকে সাহায্যের জন্য ছিল শুধু দুটি দেশি কুকুর। সোনম দোরজির মতো কাউকে খোঁজার লক্ষ্যেই শুরু করেছিলাম দিন। উদ্দেশ্য? এক বিশেষ প্রশ্নের উত্তর।
২০২০। কোভিডের ভয়াবহ গ্রাসে কাঁপছে গোটা দুনিয়া। ভারতও। জুন মাসের মাঝামাঝি খবর আসে গালওয়ান সীমান্তে চিনা ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন ভারতীয় সেনারা (Indian Army)। শহিদ হতে হয়েছিল প্রায় ২০ জনকে। এরপর থেকেই বারবার কখনও গালওয়ান, কখনও প্যাংগং, কখনও আবার সিকিমের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে এসেছে চিনা সেনার আগ্রাসনের খবর। বিরোধী দলের তরফে বারবার দাবি করা হয়েছে, ভারতীয় ভূখণ্ডের দখল নিচ্ছে চিনা ফৌজ। প্রশ্ন উঠেছে, যে প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানকে রক্তচক্ষু দেখানোর দাবি করে আসেন, লাল ফৌজের সামনে তিনি চুপ কেন? পাল্টা দাবি করে এসেছে সরকার। বলা হয়েছে, বিরোধীদের সব দাবি ভিত্তিহীন। ভারতীয় সীমান্ত আছে সুরক্ষিত।
এই দুই পক্ষের বক্তব্যের কোনটি ঠিক? কোনটিই বা ভুয়া। সেই উত্তরের খোঁজেই মাইনাস চার ডিগ্রি সেলসিয়াসে ভোর পাঁচটায় রওনা দেওয়া মেষপালকদের খোঁজে। যে ‘অসামরিক বাহিনী’ প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেশের সীমান্ত রক্ষায় বড় ভূমিকা নিয়েছেন। যাঁদের থেকে পাওয়া তথ্যে, সাহায্যে ১৯৯৯ সালের ২৬ জুলাই কারগিলে বিজয় দিবস উদযাপন করতে পেরেছে ভারতীয় সেনা। আসলে তাঁদের কাছে যে যুগের পর যুগ ধরে রয়েছে ভিসা ছাড়াই সীমান্তপারে চলে যাওয়ার অধিকার। ঠিক যেমনটা নিজেদের গবাদি পশু নিয়ে এপারে চলে আসেন চিনা মেষপালকরা। তাঁরাই যে পারেন গত কয়েক বছর ধরে ভারতীয় রাজনীতিকে উত্তাল করে তোলা এই রহস্যের সঠিক খোঁজের দিশা দিতে।
সোনম ওয়াংচুকের আন্দোলনের খোঁজ নিতে লাদাখ আসার সময় আলাপ হয় লে প্রেস ক্লাবের প্রাক্তন সচিব সেওয়াং রিগজিনের সঙ্গে। অনুরোধ করতেই রাজি হয়ে যান মেষপালকদের দেশে নিয়ে যেতে। সেই মতো ঠিক হয় ভোরে রওনা হয়ে প্যাংগং লেক ছাড়িয়ে যাওয়া হবে যাযাবর মেষপালকদের খোঁজ করতে। কিন্তু বিধি বাম। শে, থিকসে মনাস্ট্রি, স্তাকনা গুম্ফা পেরিয়ে কারু থেকে বাঁদিকে ঘুরে চেমরি, শক্তি হয়ে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর চাং লা পাসের কাছে পৌঁছতেই শুরু হয়ে যায় তুষারপাত। নিমেষের মধ্যে যার গতি বাড়তে থাকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাড়াতাড়ি কাজ মিটিয়ে সেদিনই ফিরে আসার কথা ছিল লে-তে। আবহাওয়ার পরিস্থিতি দেখে গাড়ি চালক বললেন, বিষয়টা ঝুঁকির হয়ে যাবে। অগত্যা মনখারাপ করে ফিরতেই হল। তবে সেওয়াং জানান, কারু থেকে রুমসের দিকে গেলে দেখা মিলতেই পারে মেষপালকদের সঙ্গে।
রুমসের কাছে এসে এক সময় পথে বরফের চাদর এমন ছিল, আর গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাচ্ছিল না। অগত্যা কপালের উপর ভরসা রেখে পায়ে হেঁটেই শুরু হল ‘মিশন মেষপালক’। প্রায় এক কিলোমিটার বাদে দেখা মিলল বরফহীন উপত্যকার। আরও প্রায় দুই কিলোমিটার হাঁটার পর দেখা মিলল এক পাল মেষ ও তাদের পালকের। যাঁর নাম সোনম দোরজি। সেওয়াং তাঁর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ স্থানীয় ভাষায় কথা বলার পর যা জানালেন, তার নির্যাস, “নিয়ন্ত্রণ রেখা এখান থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার। ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার ওদিকে গিয়েছি ঠিকই, এখন আর যাওয়া হয় না। তবে পরিচিত অনেকে আছে যারা নিজেদের গবাদি পশুদের ঘাস খাওয়াতে সেখানে নিয়ে যেত। কিন্তু গত কয়েক বছর নিয়ন্ত্রণরেখা তো দূর, আমাদের এলাকারও অনেক আগে আটকে দেওয়া হয়।” কী সেই কারণ? জবাবে সোনম দোরজি যা বললেন, তাতে সিলমোহর লেগে যায় বিরোধীদের দাবিতেই। অর্থাৎ দেশের ভিতরের দিকে ঢুকে এসেছে চিনা ফৌজ। সেই কারণেই কোপ পড়েছে সোনমদের চারণভূমিতে অবাধ বিচরণে।
গ্রাউন্ড জিরোয় থাকা সোনমদের কথাকে গুরুত্ব দিলে উঠে আসছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কেন বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে সোনমের মতো মেষপালকদের? কী লুকাতে চাইছে সরকার? সীমান্ত রক্ষায় নিজেদের ব্যর্থতা? চিনের কাছে অপদস্থ হওয়ার লজ্জা? না কি যেভাবে মেষপালকদের থেকে ওপারের খবরাখবর এদিকে আসে, তেমনই যাতে নিজেদের গোপন, সংবেদনশীল বিভিন্ন পরিকল্পনা ওদিকে না চলে যায়, তা নিশ্চিত করতে এই
কঠোর মনোভাব?
গত কয়েকদিনে এই নিয়ে নিজেদের কথা বলেছেন সোনম ওয়াংচুক, লাদাখ কংগ্রেসের মুখপাত্র তথা লাদাখ অটোনমাস হিল ডেভলপমেন্ট কাউন্সিলের বিরোধী দলনেতা শেরিং নামগিয়াল, বিজেপি রাজ্য সভাপতি ফুনচুক স্টানজিন, পূর্ব লাদাখের যে প্রান্তে গত কয়েক বছরে চিনের সঙ্গে এত গন্ডগোল সেই এলাকার প্রাক্তন বিজেপি, বর্তমানে নির্দল কাউন্সিলর কনচক স্ট্যানজিনরা। শেরিংয়ের বক্তব্য, “যে গরিব মানুষগুলো জীবন-জীবিকার স্বার্থে ওই দুর্গম প্রান্তরে মেষ চরাতে যান, তাঁদের তো রাজনীতি নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তাঁরা মিথ্যে বলবেন কেন?” গত কয়েকবছরে হয়ে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে কনচক স্ট্যানজিন জানিয়েছেন, “কোনও গ্রাম হয়তো চিন দখল করে নেয়নি, কিন্তু আমাদের কয়েক হাজার বর্গ কিলোমিটার ভূখণ্ডে এখন আমাদের অধিকার নেই।”
এই সব কিছুর পাল্টা দিতে গিয়ে লাদাখ বিজেপি সভাপতি ফুনচুকের গলায় সেই পুরনো সুর। “এই সব ভিত্তিহীন দাবি। সস্তার রাজনীতি করতে গিয়ে দেশের, সেনাকে অপমান করছে বিরোধীরা।” তাহলে কি নিজেদের সত্যতা প্রমাণ করতে সোনমকে সেদিন অবাধে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি চলে যেতে দেওয়া হবে? রে রে করে উঠে ফুনচুক বলেন, “খেপেছেন? এ তো দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন। হাজার হাজার লোককে ওভাবে সীমান্তে যেতে দেওয়া যায়?”
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি থেকে নানা প্রশ্ন, বক্তব্যের সঠিক উত্তর, ব্যাখ্যা হয়তো দেবে সময়। কিন্তু বলা যেতেই পারে ভারতীয় মানচিত্রের শিরস্ত্রাণ বলে পরিচিত এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার অতি গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ের প্রভাব শিয়রে থাকা লোকসভা নির্বাচনে পড়বে। পড়বেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.