ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীহরিকোটা: শ্রীহরিকোটার কাউন্টডাউন এখনও থামেনি। ঠিক যে কারণে এ পি জে আবদুল কালামের স্বপ্ন বাস্তব না হয়ে থাকতে পারে না, ঠিক সেই কারণেই চলছে প্রহর গোনা। ইসরো জানিয়েছে, চলতি মাসের শেষেই ফের চাঁদে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করবে ‘বাহুবলী’ রকেট। যার পোশাকি নাম জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল মার্ক থ্রি (জিএসএলভি-৩)। এর পিঠে চেপে ফের চাঁদে পাড়ি দেবে চন্দ্রযান ২। এই স্বপ্নের উড়ানের চেষ্টা করা হবে জুলাই মাসের শেষের দিকেই। তবে এই সময়ের মধ্যে আরও ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে তবেই চাঁদে পাড়ি দেওয়ার সবুজ সংকেত দেওয়া হবে বাহুবলীকে।
বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, এটি প্রায় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেক ভাবাবেগ ও স্বপ্ন। তাই একে নষ্ট হতে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। গোটা প্রকল্পটাকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতেই তাই ন্যূনতম ঝুঁকিও নিল না ইসরো। রবিবার মাঝরাতে ওড়ার ঠিক ৫৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড আগে স্থগিত করা হল চন্দ্রযানের দ্বিতীয় অভিযান। এদিন রাত ২টো ৫১ মিনিটে চন্দ্রযানকে নিয়ে ভারতের মাটি ছেড়ে ওড়ার কথা ছিল জিএসএলভি মার্ক থ্রি রকেটের। ইসরোর তরফে জানানো হয়েছে, প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণেই এই স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত। সূত্রের খবর, উড়ানের জন্য ক্রায়োজেনিক জ্বালানিকে যে নির্দিষ্ট চাপে ট্যাঙ্কে ধরে রাখা হয়, সেই চাপ নিতে পারছিল না তরল গ্যাস। তরল থেকে গ্যাসের আকার নিয়ে বেরিয়ে আসছিল। রাত তখন ১টা ৫৫ মিনিট।
প্রবল উৎকণ্ঠা দেশজুড়ে। উদ্বেগ চেপে রেখে প্রথমটায় কিছুটা ঠাট্টার মেজাজে ছিলেন বিজ্ঞানী থেকে ইসরোর আধিকারিক প্রায় সকলেই। শ্রীহরিকোটার লঞ্চপ্যাডের কাছে ভূগর্ভস্থ কন্ট্রোল রুমে তখন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, ইসরোর চেয়ারম্যান কে শিবনরা। প্রবল স্নায়ুযুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে সকলে। সকলেই সাফল্যের প্রার্থনা করছেন তিরুপতির কাছে। খুব নিষ্ঠার সঙ্গে বালাজির কাছে সাফল্য কামনা করেই ইসরো তাদের প্রত্যেক অভিযান শুরু করে। সবার নজর তখন বাহুবলী রকেটের দিকে। তার দুই বলিষ্ঠ বাহুতে ক্রমে দৃঢ় হচ্ছে অগাধ বিশ্বাস। লঞ্চপ্যাড থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে আমরা সাংবাদিকরা। ঘন জঙ্গল পার করে মিডিয়া সেন্টারের অডিটোরিয়ামের স্ক্রিনে চোখ। ধৈর্য যেন আর বাঁধ মানছে না। রাত একটায় সেখানে ঢোকার পর থেকে ক্রমাগত চারতলার ছাদ আর অডিটোরিয়াময়ে দৌড়োদৌড়ি করছি। নিজের মধ্যে বিশ্বাস জাগানোর পালা।
[আরও পড়ুন: ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনে জ্বালানি লিক, চাঁদমামার দেশে যাওয়া হল না চন্দ্রযানের]
অডিটোরিয়ামের বিরাট স্ক্রিনে নয়, স্বচক্ষেই দেখতে হবে ইতিহাসের এই উৎক্ষেপণ। হোক না সে দূরের কোনও জঙ্গল ঘেরা প্রান্তর। দেখাক ছোট। জ্বালানি পুড়িয়ে ওঠার মুহূর্ত নয় না-ই দেখতে পেলাম। তবু তো নিজের চোখে যতটা কাছ থেকে দেখা যায়, ঠিক ততটা কাছ থেকেই কালামের স্বপ্ন আর দেশের ভবিষ্যৎকে তার ভাগ্য পরীক্ষা করতে যেতে দেখব। উৎকণ্ঠা আর বাধ মানছিল না। যেন চার-পাঁচটা উল্কাখণ্ডই ছুঁয়ে ফেলেছি পৃথিবীর দিকে উড়ে আসার সময়। মাটিতে আর পা নেই। পায়ের নিচ থেকে জ্বালানি পুড়ে বেরচ্ছে। অনন্ত আকাশে পৌঁছচ্ছি। একেবারে অরবিটে গিয়ে চন্দ্রযানের আগমন দেখব। টগবগে তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে ভিতরের সব স্নায়ু, শিরা-উপশিরায়। সময় কমছে। মিনিটের কাঁটা সেকেন্ডের ঘড়ি মিলিয়ে দৌড়চ্ছে। প্রবল একঝাঁক হাওয়ার মধ্যেই মাঝেমাঝে প্রযুক্তিগত কিছু ঘোষণা চলছিল।
তখনও আন্দাজ করাই যায়নি যে, শেষ ঘোষণাটায় এক শীতল কণ্ঠ বলে উঠবে, “মিশন কলড অফ।” আপাতত স্থগিত রাখা হল অভিযান। পরবর্তী দিনক্ষণ পরে জানানো হবে। ঘড়ির কাঁটা তখনকার মতো সত্যিই থেমে গিয়েছে। অডিটোরিয়ামের স্ক্রিন নীল। প্রহর গুনতে গুনতে এসে ঘড়ি থেমেছে নির্ধারিত সময়ের ৫৬ মিনিট আগে। চোয়াল শক্ত করে থাকা মুখগুলোয় নাগাড়ে হতাশা। ইতিহাসের প্রথম প্রশ্নেরই বোধহয় উত্তর দিতে পারল না ইসরো। সোশ্যাল মিডিয়ায় জানানো হল, কোনও ঝুঁকি নিয়ে অভিযান শুরু করার চেয়ে সাবধানতা অবলম্বন করাই ঢের ভাল। তাই কোনও ঝুঁকি না নিয়ে ভবিষ্যৎ সুরক্ষার কথাই ভাবা হল। এখন প্রশ্ন হল, গলদ কোথায় থাকতে পারে?
সোমবার সকালেই এক দফায় জিএসএলভি রকেট পরীক্ষা করে গিয়েছেন ইঞ্জিনিয়াররা। এর পর পরীক্ষা করবেন বিজ্ঞানীরা। তিনটি পদ্ধতিতে জ্বালানি ভরা হচ্ছিল রকেটে। প্রথমে সলিড বা কঠিন বস্তু দুই বাহুতে। তার পর মূল শরীরে নিচের দিকে গ্যাস জাতীয় জ্বালানি। সবশেষে পেটে ক্রায়োজেনিক ফুয়েল। প্রথমে অক্সিজেন। পরে হাইড্রোজেন। দুটোই তরল আকারে। আগেই বলা হয়েছে, এই হাইড্রোজেন ভরার সময়েই বিপত্তি ধরা পড়ে। ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কে নির্দিষ্ট চাপ ধরে রাখতে পারছিল না এই তরল। প্রাথমিকভাবে অবশ্য মনে করা হচ্ছে, এই গলদই একমাত্র কারণ নয়। কারণ থাকতে পারে ওই ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনেও। বিজ্ঞানীদের একাংশ জানাচ্ছে, পরীক্ষা করার সময় আগেই একবার ইঞ্জিনের ফাঁকি ধরা পড়ে।
ইসরোর এক বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, যদি তা-ই হয়ে থাকে তবে একমাসের মধ্যে তা মেরামত করে নতুন করে উড়ানের প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। তবে কারণ যদি ‘ফুয়েল লিক’ হয়, সেক্ষেত্রে ধাক্কা কম করে ছ’মাস। কারণ একটা নিরাপদ অভিযান নিয়ে যে ইসরো এত খুঁতখুঁতে, সেখানে সত্যি খুঁত বেরলে তো আর কথাই নেই। গোটা ইঞ্জিন বাতিল করে নতুন ইঞ্জিন বানিয়ে তার পরীক্ষা করে তবেই তাতে জ্বালানি ভরা হবে। যা বেশ সময়সাপেক্ষ। আপাত স্থগিত হলেও অভিযান কিন্তু থামছে না।
[আরও পড়ুন: যান্ত্রিক ত্রুটির জের, আপাতত স্থগিত চন্দ্রযানের উৎক্ষেপণ]
অভিযান স্থগিত রাখাকে দেশের বাণিজ্যমহল মনে করছে অনেক বেশি সাহসের কাজ। মাহিন্দ্রা গ্রুপের চেয়ারম্যান যেমন দ্বিগুণ উৎসাহে বিজ্ঞানীদের প্রশংসায় টুইট করেছেন, “দুঃখিত হওয়ার চেয়ে নিরাপদ হওয়া ভাল। পেশাদার একটি দল তাদের কাজটা জানে। তারা বোঝে কোনও কিছুতে ন্যূনতম ঝুঁকি থাকলেও ভবিষ্যৎ সাফল্যের কথা ভেবে সেখান থেকে পিছিয়ে আসতে হয়।” বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উন্মাদনার চেয়েও বোধহয় এমন একটি কারণে গোটা দেশ রাত জেগেছে রবিবার। মাহিন্দ্রা লিখছেন, “ইসরো যেদিন আবার অভিযান করবে, আমি সেদিনও রাত জেগে বসে দেখব।”
বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা বলছে, কলকাতায় এদিন ভোরের সূর্য উঠেছে ৫টা ৪ মিনিটে। শ্রীহরিকোটায় হিসাবমতো তা আরও দেরিতে ওঠার কথা। কিন্তু ভোর সাড়ে চারটেয় সেই ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে দেখলাম মাত্র আধঘণ্টার ব্যবধানে রাত পেরিয়ে সূর্য এদিন একটু বোধহয় আগেই উঠল। দ্রুত দিন ফুরনোর অপেক্ষায় বোধহয় সে-ও। ধৈর্য তারও বাঁধ মানছে না। নতুন করে শুরু হল কাউন্টডাউন। নতুন করে শুরু স্বপ্ন দেখা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.