ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: যাকে বলে ‘ফুল ড্রেস রিহার্সাল’। চাঁদে পাড়ি দেওয়ার জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত দ্বিতীয় চন্দ্রযান। কিন্তু কতটা? যখন যানটি উড়বে, তার কলকবজা ঠিকমতো চলবে কি না, সব সিগন্যাল মানবে কি না, ইসরোর কমান্ড শুনবে কি না– তার চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু করে দিল ইসরো।
[আরও পড়ুন: বালাকোটের মতো হামলা চালাতে আত্মঘাতী ‘পঙ্গপাল বাহিনী’ বানাচ্ছে ভারত]
বৃহস্পতিবার সকালেই একপ্রস্থ প্রযুক্তিগত দিক খতিয়ে দেখা হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয়ে গেল সিগন্যাল কমান্ড মহড়ার কাজ। শুধু শ্রীহরিকোটা নয়, বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত ইসরোর নেটওয়ার্ক সিস্টেম এই যানকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে কি না, তা পরীক্ষার কাজ শুরু হল শুক্রবার। বৃহস্পতিবার সকাল সাতটা থেকে ধরলে সব মিলিয়ে ঘণ্টার হিসাবে ৬৬ ঘণ্টা।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দ্বিতীয় চন্দ্রযানের অনুমোদন দিয়েছিলেন ২০০৮ সালে প্রথম চন্দ্রযানের সাফল্যের পরই। কিন্তু তার চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে লেগে গেল ১১ বছর। ইসরোর বক্তব্য, শুধু আর্থিক নয়, প্রযুক্তিগত দিক থেকে তাদের এবারের প্রস্তুতিটা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাড়াহুড়ো করতে চায়নি তারা। যে রকেটের মহাকাশ পাড়ি দেওয়ার কথা, তার শক্তিবৃদ্ধি করা দরকার ছিল। দু’বাহু দিয়ে ৩.৮ টনের চন্দ্রযানকে জড়িয়ে মহাকাশে উড়ে যাওয়ার ক্ষমতা তার হয়েছে কি না, তার নিশ্চিত পরীক্ষা সেরেই সবুজ সংকেত দিয়েছে ইসরো।
আগামী রবিবার রাত ২টো ৫১ মিনিটে অর্থাৎ মাঝরাতে অরবিটর, বিক্রম ল্যান্ডার ও প্রজ্ঞান রোভারকে নিয়ে আকাশে উড়ে যাবে জিএসএলভি মার্ক থ্রি রকেট। তেলুগু সাংবাদিক মহল যার নাম দিয়েছে ‘বাহুবলি’। নির্মাণে এখনও পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৯৭৮ কোটি টাকা। পোশাকি নাম ‘ফ্যাট বয়’।
এই অভিযান সফল হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, চিনের পর পৃথিবী থেকে চাঁদের সবচেয়ে দূরের বিন্দুতে নামার কৃতিত্ব নিতে পারবে ভারত। তাও প্রথম দেশ হিসাবে সরাসরি চাঁদের ঠিক দক্ষিণ মেরুতে নামবে চন্দ্রযান।ঠিক হয়েছে, পৃথিবী থেকে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকবার পাক খেয়ে চন্দ্রযান পৌঁছাবে চাঁদের পিঠের কাছাকাছি। তখন প্রথমে তার গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ৬১২০ কিলোমিটার। বুলেট ট্রেনের গতিবেগের ১৪ গুণেরও বেশি। ১০ মিনিট ৩০ সেকেন্ড পর সাড়ে সাত কিলোমিটার উচ্চতায় পৌঁছাবে। গতিবেগ কমে হবে ঘণ্টায় ৫২৬ কিলোমিটার। পরের ৩৮ সেকেন্ডে তা ঘণ্টায় ৩৩১ কিলোমিটার গতিতে পৌঁছাবে ৫ কিলোমিটার উচ্চতায়।
পরবর্তী ৮৯ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছে গতিবেগ শূন্য করবে বিক্রম বা ল্যান্ডার। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে। এইখানেই সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন। চাঁদের মাটিতে নামতে গেলে কোনও বাধা আসবে কি না, তার চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে পাক খেতে খেতে। শেষে একেবারে গতি কমিয়ে ধাপে ধাপে ধীরে অবতরণ হবে। এই প্রক্রিয়াকেই বলে ‘সফ্ট ল্যান্ডিং’ বা কোমল অবতরণ। একেবারে ১০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছে চার পা বের করে অভিযানের ৫৪ দিনের মাথায় চাঁদের মাটি স্পর্শ করবে বিক্রম। সেই সংকেত তার মস্তিষ্কে পৌঁছালে পরিস্থিতি বুঝে মিনিট পনেরো পরে প্রথম চাঁদে দাঁড়িয়ে তার ছবি তুলে পাঠাবে ইসরোকে। বিজ্ঞানীমহলের মতে, সবচেয়ে রোমাঞ্চকর মুহূর্ত সেটি।
আরও চার ঘণ্টা পর তার গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসবে ছ চাকার রোভার বা প্রজ্ঞান। চাঁদের শীতল মাটিতে ঘুরে ঘুরে শুরু হবে এক বছর ধরে গবেষণার কাজ। ল্যান্ডার আর রোভারের গায়ে আঁকা থাকবে জাতীয় পতাকা। রোভারের চাকায় আঁকা থাকবে অশোকচক্র। চাঁদের মাটিতে প্রথম ঘুরে বেড়ানোর চূড়ান্ত আবেগঘন মুহূর্ত সেটি। ইসরো ইতিমধ্যে এই নিয়ে তাদের টুইটারে বেশ কিছু প্রশ্ন রেখেছে। কুইজের মাধ্যমে জানতে চেয়েছে, চাঁদের মাটিতে পৌঁছাতে কী কী সঙ্গে রাখা উচিত। সকলেরই প্রথম উত্তর, জাতীয় পতাকা।
চূড়ান্ত কাউন্টডাউনের আগে তারই এখন ফুল ড্রেস রিহার্সাল চলছে ইসরোর আঁতুড়ঘরে। সিগন্যাল পরীক্ষার পর শুক্রবার প্রায় গোটা দিন ধরে চলেছে রকেট ও যানের স্বাস্থ্যপরীক্ষা। এদিন রাত থেকে শুরু হয়েছে যানের ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার কাজ। স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজ চূড়ান্তভাবে শুরু হয় শনিবার সকাল থেকে। অরবিটর, ল্যান্ডার চালু করা হবে পরীক্ষার জন্য। রাতে দেওয়া হবে নিরাপত্তার ছাড়। রবিবার সকালে ফের একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর, রাতে আবারও যানের সব কবজা একবার করে চালু করে দেখা হবে। রাত বারোটায় শুরু হবে লঞ্চপ্যাডের মূল কর্মসূচি। একে একে চালু হবে সমস্ত প্রক্রিয়া। মাঝরাতে দেশের মাটি ছেড়ে উড়ে যাবে ‘ফ্যাট বয়’।
[আরও পড়ুন: তুঙ্গে চন্দ্রযান-২ অভিযানের প্রস্তুতি, ঢিল ছুঁড়ে জল মাপার পর এবার চাঁদের মাটিতে পা]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.