সন্দীপ চক্রবর্তী: গুমনামি বাবার (Gumnami Baba) ডিএনএ-র নির্যাস প্রকাশ্যে জানাতে অস্বীকার করল সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরি। কারণ হিসাবে বলা হল, এই ইলেকট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট সর্বসমক্ষে জানালে বিঘ্নিত হতে পারে দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বদলে যেতে পারে রাজনীতির রসায়ন। সম্পর্ক খারাপ হবে বহু দেশের সঙ্গে! আর এই কেন্দ্রীয় সংস্থার ‘প্রত্যাখ্যান’ই নেতাজি অন্তর্ধান রহস্যকে নতুন মাত্রা দিল।
বস্তুত, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর (Netaji Subhas Chandra Bose) সঙ্গে ফৈজাবাদের গুমনামি বাবা বা ভগবানজির বিস্ময়কর মিল নিয়ে চর্চা জারি রয়েছে। একটি বড় অংশের জোরালো দাবি, তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। তিনি ফিরে এসেছিলেন ভারতেই। সাধু ভগবানজিই নেতাজি কি না সেটা জানতে মুখার্জি কমিশন গুমনামি বাবার DNA পরীক্ষাও করায়। ফরেনসিক ল্যাবরেটরি থেকে দেড় পাতার একটি রিপোর্টে ‘দায়সারা’ভাবে নেতাজির সঙ্গে ভগবানজির মিল নেই বলে জানানো হয়েছিল। পরে বিচারপতি মনোজ মুখোপাধ্যায় স্পষ্ট করেন, তাইহোকুতে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি।
সেই রহস্য উদঘাটনে জাতির স্বার্থেই ‘মিশন নেতাজি’র সদস্যরা সক্রিয় হয়েছেন। সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখ মিশনের সক্রিয় সদস্য সায়ক সেন গুমনামি বাবার ডিএনএ-র ইলেকট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট জানতে আরটিআই করেন। ডিরেক্টরেট অফ ফরেনসিক সায়েন্সেস সার্ভিসেসের কলকাতা শাখার পক্ষে তিনদিন আগে অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর জানানো হয় যে, গুমনামি বাবার ডিএনএ টেস্টের ইলেকট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট ল্যাবরেটরিতেই রয়েছে। উল্লেখ্য, ইলেকট্রোফেরোগ্রাম হল, অনেকটা এক্স রে প্লেটের মতো।
সেটি থাকলে যে কোনও ডিএনএ বিশেষজ্ঞ ‘সিকোয়েন্স’ ম্যাচ করিয়ে দু’টির সঙ্গে মিল করাতে পারেন। নেতাজির বাবা ও মায়ের পরিবারের অনেকেরই যেহেতু এই ইলেকট্রোফেরোগ্রাম রয়েছে, তাই ভগবানজির সঙ্গে ‘ম্যাচ’ অর্থাৎ সজ্জার বিন্যাস একত্রিত করা অসম্ভব ছিল না। বলা ভাল, দেশের তাবড় ডিএনএ বিশেষজ্ঞরা রাজিও ছিলেন এবং রয়েছেন।
‘মিশন নেতাজি’র পক্ষে আরটিআইয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ১) মুখার্জি কমিশনের তত্ত্বাবধানে গুমনামি বাবার যে ডিএনএ টেস্ট করা হয়, তার ইলেকট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট কলকাতা সিএফএসএল-এ রয়েছে কি না। ২) না থাকলে রিপোর্ট ধ্বংসের সরকারি কপি। ৩) রিপোর্টটি থাকলে যেহেতু মুখার্জি কমিশনে তা দেওয়া হয়নি এবং যেহেতু মুখার্জি কমিশনেরও অবলুপ্তি ঘটেছে, তাই তৃতীয় পক্ষের হাতে স্থানান্তরের প্রসঙ্গ উঠছে না। একমাসের আগেই উত্তর হিসাবে তালিকাক্রমে যা জানানো হয় তা হল, ১) কোনও এক গুমনামি বাবার ডিএনএ টেস্টের ইলেকট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট এই ল্যাবরেটরিতেই রয়েছে। ২) প্রশ্নই উঠছে না। ৩) আরটিআই অ্যাক্ট, ২০০৫-এর ৮(১)(এ) ও (ই) ছাড়াও ১১(১) ধারায় নির্দিষ্ট এই রিপোর্টের কপি হস্তান্তর করা যাবে না।
এই তিনটি ধারার উল্লেখ করাতেই বিতর্ক ও রহস্য আরও গভীর গাঢ় হয়েছে। ৮(১)(এ) ধারা অনুযায়ী ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি, নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হলে, রাষ্ট্রের কৌশলগত, বিজ্ঞানগত বা অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বিঘ্নিত হতে পারে বা অপরাধের উসকানি দেয়, এমন তথ্য দেওয়া যাবে না। একই ধারার (ই) উপধারায় আবার বলা হয়েছে, বৃহত্তর জনস্বার্থ না থাকলে দেওয়া যাবে না। প্রথম উপধারা দেখিয়ে কেন এক ‘সাধারণ সাধু’র রিপোর্ট দিতে এত অনীহা, প্রশ্ন সেখানে। সায়ক এমনও বললেন, ‘‘জাস্টিস মুখার্জির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উনি আমাকে বলেইছিলেন, তিনি প্রায় একশোভাগ নিঃসন্দেহ ছিলেন যে, রিপোর্ট জাল করা হয়েছিল। নাম কা ওয়াস্তে দেড় পাতার একটি রিপোর্ট পাঠানো হয়। কিন্তু যেহেতু সরকারি রিপোর্ট, তাই বেসরকারিভাবে চেক করার ছিল না।’’
নেতাজি গবেষক ও ঐতিহাসিক চন্দ্রচূড় ঘোষের আবার স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘একজন অচেনা, অজানা লোকের ডিএনএ টেস্টের ইলেকট্রোফেরোগ্রাম রিপোর্ট পেশ হলে দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হবে, এটা তো বিপজ্জনক যুক্তি। তা হলে রহস্য যে রয়েছে, তা স্বীকারই করা হল। আসলে এটা ফরেনসিক ‘জালিয়াতি’। যারা জাস্টিস মুখার্জিকেই আসল রিপোর্ট দেয়নি, তারা জালিয়াতি করবে, এটা স্বাভাবিক।’’ কোনও একজনের মৃত্যুর ৩৭ বছর পরও যদি তঁার রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলে বৈদেশিক সম্পর্ক খারাপ হতে পারে বা দেশের সার্বভৌমত্ব-সংহতি ক্ষুণ্ণ হতে পারে, তা হলে সেই ব্যক্তি সাধারণ কেউ নন, সন্দেহ নেই। নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে জাল গোটানোর সময় এসেছে, বলছেন বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদরা। চাইছেন দেশের মানুষও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.