তরুণকান্তি দাস, ভোপাল: ‘পুলিশি অত্যাচারে’ প্রায় পঙ্গু। কিন্তু মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত, ভোপালের বিজেপি প্রার্থী সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর মুখ খুললেই বিস্ফোরণ। এবং দলের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর ভোপালে যেদিন থেকে পা রেখেছেন সেদিন থেকেই রোজ ‘একাঙ্ক নাটক’। আরও স্পষ্ট করে বললে একক পালা। বৃহস্পতিবার যেমন ভোপালে তিনি বলেছেন, “লকআপে আমার উপর দিনের পর দিন পুলিশি অত্যাচারের সময় হেমন্ত কারকারেকে অভিশাপ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ভয়ানক মৃত্যু হবে তাঁর। সেই অভিশাপ ফলে গিয়েছে।”
[খুচরোর জ্বালায় জেরবার, ত্রিশ কিলো কয়েন দিয়ে মনোনয়নপত্র নিলেন বৃদ্ধ]
সাধ্বীর এই মন্তব্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়তেই তোলপাড় পড়ে যায়। শুধু ভোপাল নয়, রাজধানী দিল্লিতে, গোটা দেশে। বিষয়টি নিয়ে আসরে নেমে পড়ে বিরোধী দলগুলি। প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমা চাইতে হবে বলে দাবি করে কংগ্রেস। তীব্র নিন্দা করে আইপিএস-দের সংগঠন। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। ভোটের মুখে প্রতিক্রিয়ার বহর দেখে ব্যাপক চাপে পড়ে যায় বিজেপি। বিষয়টি থেকে দূরত্ব তৈরি করে দল। বিবৃতি দিয়ে জানায়, হেমন্ত কারকারে মুম্বইয়ে সন্ত্রাস হামলার শহিদ। এটা সম্পূর্ণই সাধ্বীর ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া। অমানুষিক অত্যাচারের কারণেই হয়তো তাঁর এই মন্তব্য। কিন্তু তাতেও তেমন লাভ হয় না। টুইট করে কংগ্রেস রাহুল গান্ধী বলেন, “একজন শহিদকে প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া উচিৎ।” শেষ পর্যন্ত দলের চাপেই হয়তো রাতে অবস্থান বদল করেন প্রজ্ঞা। বিবৃতি দিয়ে বলতে বাধ্য হন, ‘কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত দিতে চাইনি। কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন তাহলে ক্ষমা চাইছি। আমি এভাবে বলিনি। আমার মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।’ এমনকী, প্রজ্ঞা উলটে প্রয়াত কারকারেকে ‘শহিদ’ বলেও মন্তব্য করেন। বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি, এই মন্তব্য দেশের শত্রুদের সুবিধা করে দেবে। তাই মন্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইছি। আমার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা যাই থাক, উনি শত্রু দেশের জঙ্গিদের গুলিতে মারা গিয়েছেন। অবশ্যই তিনি একজন শহিদ।’ প্রজ্ঞা সুর নরম করলেও তাতে কতটা কাজ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আগামিদিনে বিরোধীরা নিশ্চিতভাবেই একে অস্ত্র করতে চলেছে।
প্রজ্ঞা বৃহস্পতিবার কারকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “মালেগাঁও বিস্ফোরণ কাণ্ডে গ্রেপ্তার করে আমাকে পুরো নগ্ন করে মারধরের হুমকি চলত। শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়েছে তৎকালীন পুলিশকর্তা হেমন্ত কারকারের নির্দেশেই। ইউপিএ সরকারের আমলে পুলিশের একটা গোষ্ঠী জঙ্গিদের মদত দিত। দেশদ্রোহিতা করলেও কংগ্রেসের নির্দেশে হাত গুটিয়ে বসে থাকত। আর আমাদের মতো লোকজনকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাত। আমাকে যেদিন লকআপে ভীষণ অত্যাচার করা হয়, যার জেরে আমার নিম্নাঙ্গ অনেকটাই কর্মক্ষমতা হারিয়েছে, সেদিন হেমন্ত কারকারেকে বলেছিলাম, এত পাপ করো না। অভিশাপ দিচ্ছি, তোমার ভয়ানক মৃত্যু হবে। অকালে চলে যাবে। তাই হল। মিলে গেল অভিশাপ।” প্রজ্ঞার এই বিতর্কিত মন্তব্যের পরেই ঝড় ওঠে সবমহলে। পুলিশ কর্তারা বলেছেন, এতে মনোবল ভাঙবে। কংগ্রেস এটাকে ইস্যু করে মাঠে নেমে পড়েছে। আর তিনি? শুক্রবার সকালেও বিকারহীন মন্তব্য করেছেন, “সত্যমেব জয়তে।” পরে রাতে অবশ্য ঢোক গিলতে বাধ্য হলেন।
অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াডের মাথা, এনকাউন্টার স্পেশ্যালিস্ট হেমন্ত কারকারে মুম্বইয়ে ২০০৮ সালের ২৬/১১ জঙ্গি হানার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মৃত্যু হয় আরও দুই পদস্থ কর্তার। তাঁকে মরণোত্তর অশোকচক্র সম্মান দেয় সরকার। এরকম একজন আইপিএস অফিসারকে নিয়ে প্রজ্ঞার মন্তব্যে স্তম্ভিত বিভিন্ন মহল। আইপিএস অফিসারদের সংগঠন টুইট করেছে, ‘জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন কারকারে। শহিদ হিসাবেই তাঁকে দেখেছে দেশ। সম্মান দিয়েছে সরকার। এমন একজন পুলিশকর্তার মৃত্যু নিয়ে এমন মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক। নিন্দার ভাষা নেই।’ মধ্যপ্রদেশ রাজ্য কংগ্রেসের মুখপাত্র পঙ্কজ চতুর্বেদী বলেছেন, “মানুষ বুঝুক কাকে সংসদে পাঠাতে চাইছে বিজেপি।”
ভোপালে আসনের প্রার্থী নিয়ে টালবাহানার পর প্রজ্ঞাকে প্রার্থী করে বিজেপি। আরএসএসের চাপ ছিল এই আসনে অতি হিন্দুত্ববাদী কোনও মুখ খুঁজে বের করার। সংঘ প্রথমে উমা ভারতীকে লড়তে বলে। তিনি রাজি হয়েও শেষে হঠাৎ পিঠটান দেওয়ায় সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে পাঠানো হয়। জনকে সনাতন আশ্রমের লোক এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদী মুখগুলির অন্যতম বলেই চেনে দেশ। যাঁর নাম বেশি করে চর্চায় উঠে আসে মালেগাঁও বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ায়। প্রায় আট বছর জেলে কাটিয়ে আপাতত অসুস্থতার কারণে জামিন পেয়েছেন। তাঁর প্রার্থী হওয়া নিয়ে মামলাও করেছে বিস্ফোরণে নিহতদের পরিবার। যদিও আদালত তাঁকে প্রার্থী করার ক্ষেত্রে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি।
ভোপালে এসে নিয়মিত সংঘ কার্যালয়ে যাচ্ছেন প্রজ্ঞা। শুক্রবারও বিকেলে সেখানে যান তিনি। তার আগে বলেন, “কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ফারুক আবদুল্লা দেশদ্রোহী। দেশের মানুষের ভোটে জেতেন কিন্তু অন্য দেশের হয়ে সওয়াল করেন। ওঁদের জন্যই কাশ্মীরে যত অশান্তি। ওঁদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া উচিত।” দেশপ্রেম জাগাতে কথায় কথায় বিদ্রোহ এবং উসকানি যেমন আছে, তেমনই তাঁর প্রতি যাতে আবেগ ও সহানুভূতির ভোটবৃষ্টি হয় সেদিকে খেয়াল রেখে মাঝেমধ্যে চোখ থেকে জলও ঝরাচ্ছেন। “ধর্মের জয় হবে। অধর্মের বিনাশ” বলেই গীতার বাণী আওড়াচ্ছেন। কিন্তু একটা মন্তব্যই তাঁকে দেশের মানুষের কাছে বোধহয় ‘খলনায়িকা’ বানিয়ে দিল। ভোট বাক্সে তার কতটা প্রভাব পড়বে, এখন সেটাই দেখার।
[পাঁচ ঘণ্টার অপেক্ষা, রাহুলের দেখা পেল না সাত বছরের শিশু]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.