সোমনাথ রায়, নয়াদিল্লি: ওরা বাবাকে কাঠের উপর শুইয়ে দিল। একটু পরে আগুন লাগিয়ে দিল। তারপর থেকে আর বাবাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন গো?
দাদু ঝন্টু দাসের কোলে খেলনা গাড়িতে দম দিতে দিতে বলছিল পাঁচ বছরের ছোট্ট তন্ময়। ছেলের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল সদ্য স্বামী হারানো তনুশ্রী (২৪)। লালকেল্লার সামনে তোলা আঠাশ বছরের ছেলের ছবি হাতে হাপুশ নয়নে কেঁদেই চলেছেন মা শান্তি। আর বাবা মন্টু তখন বস্তির দশ বাই সাতের ঘুপচি ঘরের বাইরে বসে নিজেকে দোষ দিয়েই যাচ্ছেন। “কেন যে মরতে ছেলেটাকে ডেকে এনেছিলাম? জানেন ওর ইচ্ছা ছিল না দিল্লিতে এসে নোংরা ঘাঁটার এই কাজ করার।” বলছিলেন আগেরদিনই বড় ছেলের মুখে আগুন দিয়ে আসা অভাগা বাবা।
সোমবার মাঝরাতে দিল্লিজুড়ে বয়েছে দমকা ঝড়। দিল্লি (Delhi) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার দুরের আজাদপুরের জাহাঙ্গিরপুরির ঘিঞ্জি বস্তিতে থাকা বাঙালি পরিবার তখনও জানত না তার কয়েকঘণ্টা বাদেই তাঁদের জীবনে আসছে আরও বড় ঝড়। যাতে তছনছ হয়ে যাবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমা থানা অন্তর্গত রাক্ষসখালি গ্রামের প্রবাসীদের আস্ত সংসারটাই।
আর পাঁচদিনের মতো সেদিন সকালেও বাবা মন্টুর সঙ্গে কাজে বেরিয়েছিলেন অসিত দাস। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁরা নোংরা নিয়ে আসেন। সেখান থেকে আসে কিছু টাকা। তারপর আবর্জনায় বসে নোংরা থেকে জিনিস ঝাড়াই বাছাই করে তা বিক্রি করেও উপার্জন হয় কিছু টাকা। রাস্তায় ভ্যানের চাকা পাংচার হয়ে গেলে গ্যারেজে সারাই করতে দিয়ে বাড়ির দিকে টাকা নিতে যায় সে। এমন সময়ই দু’টি বাইকে করে এসে তাঁকে মারধোর করতে করতে তুলে নিয়ে যায় মেট্রো প্রোজেক্টে কর্মরত চারজন গার্ড। এমনটাই দাবি স্থানীয় চা বিক্রেতা শেহনাজের। খবর পেয়েই আশপাশের তিনটি থানায় খোঁজখবর শুরু করেন অসিতের পরিজনরা। দুপুরের দিকে জাহাঙ্গিরপুরি থানা থেকে খবর আসে, খালের ধারে একটি লাশ পাওয়া গিয়েছে। স্থানীয় জগজীবন হাসপাতালে গিয়ে শনাক্তও হয় লাশ। এরপরই দোষীদের শাস্তির দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক পথ অবরোধও করেন হাজার দুয়েক মানুষ। এরপর প্রশাসনের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়, দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। গ্রেপ্তার হয় দু’জন।
এই ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়। যেখানে দেখা যাচ্ছে অসিতকে কার্যত গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাঁর আত্মীয়দের অভিযোগ অসিতকে ইলেকট্রিক শকও দেওয়া হয়েছে। এই ভিডিওগুলিতে থাকা দু’জনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেই পুলিশ সূত্রের খবর। বাকিদেরও খোঁজ চলছে।
এই পরিস্থিতিতে কীভাবে ভবিষ্যৎ চলবে, তা ভেবে পাচ্ছেন না অসিতের বাবা মন্টু। তাই দিল্লির রেসিডেন্ট কমিশনারের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে সাহায্য চাইলেন তিনি। অসিতের স্ত্রী তনুশ্রী উচ্চমাধ্যমিক পাশ। তাঁর জন্য যদি কোনও চাকরির ব্যবস্থা করা যায়, সেই আবেদন করলেন। মন্টু বলছিলেন, “গত ১১ বছর আমি দিল্লিতে। আমার কাজ নোংরা ঘাঁটা। অসিত সেটা করতে চাইত না। ও তাই ত্রিপুরা গিয়ে ঠিকে মজুরি করত। লকডাউনের সময় পাথরপ্রতিমার বাড়িতে চলে যায়। সেই থেকে বসা। মাস দু’য়েক আগে আমি ফোনে বললাম, বাপ আমার তো বয়স হচ্ছে। একা আর টানতে পারছি না। তুই চলে আয়। তখনই বউ, ছেলেকে নিয়ে ও এল।” তনুশ্রীর কথায়, “ও এখানে আসতে চাইত না। বলত দিল্লি বিপজ্জনক জায়গা। আমাদের মত যারা বাইরে থেকে এসে কাজ করে, তাদের থেকে পুলিশ জোর করে টাকা নেয়। তবু শ্বশুরমশাইয়ের কথা ও ফেলতে পারেনি। এখন ভাবছি, কেন এলাম? জানি না বাচ্চাটার কী হবে?”
তনুশ্রী যখন এই কথা বলছেন, তখন ঘরের ভিতর নিজের মনে খেলে চলেছে ছোট্ট তন্ময়। দৌড়ে বেরোতে গিয়ে কীসে যেন হোঁচট খেল। সেদিকে তাকিয়ে গুমরে উঠলেন মা শান্তি দাস। বললেন, “ছেলেটা আলুর দম খেতে ভালবাসত। সেদিন বানিয়েছিলাম। টিফিন বক্সে রুটির সঙ্গে দিয়েছিলাম। ওই দেখুন, ওই অবস্থায়…” কথা থামল না মায়ের। ওদিকে ‘বাবা কই? কখন আসবে?’ জিজ্ঞেস করেই চলেছে ছোট্ট তন্ময়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.