ফাইল ছবি
শংকর ভট্টাচার্য: কোথায় গেল বাম ভোট? বঙ্গভোট শেষ হওয়ার পরেও এই আলোচনা এখনও চলছে। বিশেষ করে রাজ্য সিপিএমের (CPM) অন্দর এখন এই প্রশ্নেই আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে। ভোট মিটতেই রাজ্য নেতৃত্বকে কার্যত কাঠগড়ায় তুলেছেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, তন্ময় ভট্টাচার্যর মতো নেতারা।
ঠিক উলটো ছবি দক্ষিণের রাজ্য কেরলে (Kerala)। সেখানে প্রশ্ন ‘রাম’ ভোট কোথায় গেল? গেরুয়া ভোটে কারা ফায়দা তুলল কেরল থেকে? কেরল সিপিএমের দাবি, গেরুয়া ভোট গিয়েছে কংগ্রেসের দিকে। যা মোটেই বিশ্বাস করতে চাইছে না কেরল বিজেপির একাংশ। তাঁদের পালটা যুক্তি, লাল বাক্সেই পড়ছে ‘রাম’ ভোট। আর এই যুক্তি-পালটা যুক্তি নিয়েই কেরল রাজনীতিতে তুঙ্গে উঠেছে বিতর্ক।
‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন নিয়েই এবার বঙ্গভোটের ময়দানে নেমেছিল বিজেপি (BJP)। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতাদের আশা ছিল, ভাল ফল হবে কেরলেও। দক্ষিণের এই রাজ্য থেকে কমপক্ষে ৪০ আসন দাবি করেছিল বিজেপি। কেরলের বিজেপি সভাপতি কে সুরেন্দ্রনের দাবি ছিল, এবার তাঁরা ৪০-এর কাছাকাছি আসন পাবেন। কিন্তু ফল প্রকাশ হতেই দেখা যাচ্ছে, বাংলার মতো কেরলেও বিজেপির অবস্থা তথৈবচ। এ রাজ্যে সিপিএম শূন্য। আর কেরলে বিজেপির স্কোর একই। তাতেই প্রশ্ন উঠছে, কোথায় গেল বিজেপির ভোট?
রাজনৈতিক মহলের দাবি, এবারের নির্বাচনে মোদি ভক্তরা ঢেলে ভোট দিয়েছেন সিপিএমকেই। তাই পাঁচ বছর অন্তর সরকার পরিবর্তনের দস্তুর বদলে দিয়ে ইতিহাস তৈরি করেছেন বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা পিনারাই বিজয়ন। ১৪০ আসনের বিধানসভায় ৯৭ আসন নিয়ে সরকার গঠন করছেন তিনি। ‘মেট্রো ম্যান’ ই শ্রীধরণকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরেও ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি। তিনি নিজেও হেরেছেন পালাক্কাড থেকে।
প্রশ্ন হল, বাংলায় একদা শক্তিশালী ছিল বাম দুর্গ। কেরলে বিজেপি সেই জায়গাতেই নেই। তাহলে কেন এত তুলনা, আলোচনা। আসলে গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে দক্ষিণের এই রাজ্যে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে গেরুয়া শিবির। বিশেষ করে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে পুরসভা ও পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপির ভোট শতাংশ তাক লাগিয়ে দেয় রাজ্যের ভোট বিশ্লেষকদেরও। প্রায় ২০ শতাংশ ভোট পায় বিজেপি। এর আগে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ১০.৫ শতাংশ ভোট। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে গেরুয়া বাহিনীর ঝুলিতে পড়েছিল ১৫.৫৬ শতাংশ ভোট। যা হেলাফেলা করা যায় না।
এবার কিন্তু সেই ভোট কমে হয়েছে মাত্র ১১.৩ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে কেরলে খাতা খুলে সবাইকে চমকে দিয়েছিল বিজেপি। রাজধানী তিরুবনন্তপুরমের অদূরে নেমন আসন জিতেছিলেন বিজেপির প্রবীণ নেতা ও রাজাগোপাল। এবার সেটাও হাতছাড়া হয়ে হিয়েছে। ওই আসনে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। অথচ, গত কয়েক বছরে কেরলের উত্তরাংশে নিজেদের ক্রমশ সক্রিয় করেছে আরএসএস। দক্ষিণ ভারতের মধ্যে তাদের সবচেয়ে বেশি শাখা এই রাজ্যেই। কিন্তু তারপরেও গেরুয়া ভোট কোথায় গেল, তা নিয়ে তদন্তে নামলে হয়তো ফেল করে যাবেন ফেলুদাও।
এবার ভোটের আগেই কিন্তু এই রহস্য অনেকটা ফাঁস করেছিলেন দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবী আর বালাশংকর। তাঁর অভিযোগ, এবারের ভোটে বিজেপির সঙ্গে বামেদের গোপন ‘ডিল’ হয়েছে। গেরুয়া ভোটের অধিকাংশই যাবে লালের বাক্সে। এই বক্তব্য সত্যি না মিথ্যে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে তা নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হচ্ছে। তাই তড়িঘড়ি যুক্তি সাজাতে হচ্ছে পিনারাই বিজয়নের (Pinarayi Vijayan) মতো বাম নেতাকেও। তাঁর দাবি, মোটেই না। গেরুয়া ভোট গিয়েছে কংগ্রেসের দিকে। বিজয়নের বক্তব্য, ‘‘গেরুয়া ভোট পেয়েই কম করেও ১০টি আসনে জিতেছে ইউডিএফ। না হলে বামেদের অবস্থা আরও ভাল হতো।’’ তিনি তথ্য দিয়ে দাবি করেছেন, ‘‘গত বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে ৯০ আসনে ভোট কমেছে বিজেপির। আর সেই ভোট গিয়েছে কংগ্রেসের দিকে। না হলে আরও ভাল ফল করতে পারতাম।’’
বিজয়নের নিশানায় বিজেপির-কংগ্রেসের গোপন আঁতাঁত। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি। বিজেপির রাজ্য সভাপতি কে সুরেন্দ্রন বলেন, ‘সব বাজে কথা। আমাদের ভোট কেন কমল, তা বিশ্লেষণ করে দেখছি।’ তবে এই বিষয়ে কেরলের প্রবীণ বাম বুদ্ধিজীবী বি কে নায়ার জানান, ‘‘কেরলে হিন্দু দল হিসাবেই পরিচিত সিপিএম। আর সংখ্যালঘু ভোট মূলত যায় ইউডিএফের (UDF) দিকে। আরএসএস বহু জায়গায় শক্তিশালী হলেও, দীর্ঘদিন ধরে ভোট চলে যায় বামেদের দিকে। গত কয়েক বছর বিজেপির ভোট বৃদ্ধি পাচ্ছিল সেই প্রথা ভেঙে। কিন্তু এবার রামের ভোট বামেই ফিরে গিয়েছে। তার সঙ্গে বিজয়নের উদ্যোগে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একাংশ ভোট এসেছে এলডিএফের দিকে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দল বলে পরিচিত কেরল কংগ্রেস (মানি) যোগ দেয় এলডিএফে (LDF)। আর বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে মুসলিমদের একাংশ এবার বামেদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাই এই ইতিহাস তৈরি হয়েছে।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.