ছবি:প্রতীকী
কৃষ্ণকুমার দাস, পহেলগাঁও: অমরনাথ যাত্রার (Amarnath Yatra) তীর্থযাত্রীদের পাশাপাশি তাঁরা যে ঘোড়ার পিঠে চেপে হিমালয়ের গুহায় পৌঁছবেন সেই প্রাণীরও দুর্ঘটনা বিমা করছে জম্মু কাশ্মীর সরকার। তাৎপর্যপূর্ণ হল, পুণ্যার্থী ও ঘোড়া, দুজনের বিমায় ক্ষতিপূরণ বাবদ মিলবে একই পরিমাণ অর্থ, পাঁচ লাখ টাকা। অমরনাথ যাত্রীদের মূল বেসক্যাম্প পহেলগাঁওয়ের লিডার নদীর ধারে বসে সোমবার অনন্তনাগ জেলা প্রাণীসম্পদ আধিকারিক মোশারফ খান দাবি করেন, দেশের মধ্যে এই প্রথম পুণ্যার্থীদের বহনকারী ঘোড়ার এমন বিমা চালু হল।
‘আর কইয়েন না কত্তা, ঘুড়ায় হাসবো’-বিমার কথা শোনার পর থেকেই বহুল প্রচলিত এই বাংলা প্রবাদটির কথা বারে বারে কানে বাজছে। তবে ঘোড়া হাসছে কি না তা দেখতে না পেলেও মালিক ও ‘পনিওয়ালা’(ঘোড়ার সঙ্গে থাকা দক্ষ কর্মী), দুপক্ষই খুবই খুশি। কারণ, প্রতিবছরই চন্দনবাড়ি থেকে প্রায় ৩৫ কিমি পাহাড়ি দুর্গম পথ ঘোড়ার পিঠে যাত্রা করার সময় অজস্র দুর্ঘটনা ঘটে। একাধিক ঘোড়ার পাশাপাশি পনিওয়ালাদেরও মৃত্যু হয়। ঘোড়ার বিমার জন্য তৈরি অস্থায়ী শিবিরের বাইরে দেখা দুই পনিওয়ালা মুবারক ও সাজিদের সঙ্গে। কিছুটা উত্তেজিত হয়ে সাজিদ বলছিল, ‘‘অমরনাথ যাত্রীদের নিয়ে শিব ঠাকুরের গুহায় যাওয়ার পথে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। ঘোড়া থেকে পড়লে গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে সুদে টাকা ধার করতে হত। কেউ খবর নিতেন না।’’ স্বভাবতই তীর্থযাত্রীদের জন্য বাহনের সঙ্গে পনিওয়ালাদের বিমার আওতায় আনতেই খুশির হাওয়া অনন্তনাগ ও গান্ধেরবাল জেলার ঘোড়ার সঙ্গে যুক্ত রোজগার নির্ভর পরিবারেও। উল্লেখ্য, আগামী ৩০ জুন থেকে পহেলগাঁও-এর চন্দনবাড়ি থেকে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী ত্রিস্তর নিরাপত্তার বেষ্টনির মধ্যে অমরনাথ যাত্রা শুরু করবেন। চলবে রাখিবন্ধনের দিন ১১ আগস্ট পর্যন্ত।
কিন্তু ইতরপ্রাণীর বিমা (Horse Insurance) হচ্ছে কীভাবে ? বিমার ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করা সেই বিরল প্রক্রিয়া দেখতে পহেলগাঁও থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে চন্দনবাড়ি পৌছলাম। দূর থেকে দেখি লিডার নদীর ধারে ত্রিপল খাটিয়ে তৈরি শিবিরের সামনে ঘোড়া থিকথিক করছে। প্রাণী সম্পদ দফতর, পশুচিকিৎসক, জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি এবং অবশ্যই হাজির বিমা সংস্থার কর্তারা। আসলে যতক্ষণ না প্রাণীসম্পদ দফতর ঘোড়াকে ফিট সার্টিফিকেট দিচ্ছে ততক্ষণ বিমা হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে পশু চিকিৎসক ও প্রাণিসম্পদ দফতরের লোকেদের পোয়াবারো। যথারীতি কাঁঠালের উপর মাছি ভনভন করার মতো দালাল ঘুরছে। কেন্দ্র শাসিত জম্মু কাশ্মীরের (Kashmir) উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ঘোড়া ও মালিকদের জন্য বিমার ব্যাবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সেই বিমা দ্রুত করাতে গিয়ে টেবিলের তলায় পাঁচশো-হাজার চলে যাচ্ছে। কাগজপত্র ছাড়াও ঘোড়ার ডানদিকের কানে পাঞ্চিং মেশিন জাতীয় যন্ত্র দিয়ে নম্বর ও মালিক এবং ঘোড়ারও নাম লেখা হচ্ছে। মজার কথা হল, বেতাব ভ্যালী, সোনমার্গ ও বৈষ্ণোর উপত্যকায় তিনটি পৃথক ঘোড়ার নাম ‘বাদল’ এবং ‘বাদশা’ পেলাম। আর একটা বিষয়, পর্যটকদের নিয়ে যে ঘোড়াগুলি ঘুরে বেড়ায় তার চেয়ে কিন্তু এই বিমা করাতে আসা পুণ্যার্থীদের বাহনগুলি অনেক বেশি তাজা ও চকচকে লাগছিল।
প্রশ্ন একটাই, অনন্তনাগ ও গান্ধেরবাল, দুই জেলাকে মাত্র পাঁচ হাজার ঘোড়ার বিমা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু স্বয়ং উপরাজ্যপাল দিন কয়েক আগে দাবি করেছেন, তিন বছর অমরনাথ যাত্রা বন্ধ থাকার পর এবার রেকর্ড পুণ্যার্থী দেবাদিদেব দর্শনে আসছেন। আর এর ৮০ শতাংশের বেশি চন্দনবাড়ি থেকে হয় পায়ে হেঁটে নয়তো ঘোড়ায় চেপে পবিত্র গুহায় পৌঁছাবেন। তা হলে, এই মাত্র পাঁচ হাজারের বিমা করিয়ে কি হিন্দুভোটের সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা? কেন্দ্রকে নিশানা করে বলছিলেন, ছয়টি ঘোড়ার মালিক ফারুক শেখ। আসলে, ফারুক ভাইয়ের মাত্র দুটো ঘোড়া বিমায় নথিভুক্ত করেছে। আর দেবে না জানিয়ে দিয়েছেন অতিরিক্ত কমিশনার।
কোভিডের কারণে ২০২০ ও ২০২১, দুবছর ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপের জেরে অমরনাথ যাত্রা বন্ধ ছিল। এবছর অতিরিক্ত শিবভক্ত যেমন আসছে তেমনই দীর্ঘদিন ঘাপটি মেরে থাকা পাক জঙ্গিরা (Pakistani Terrorist) নাশকতা ঘটাতে পারে, এমন আশঙ্কা প্রবল। এরই মধ্যে গত ৭ মে পহেলগাঁও থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে তিন হিজবুল মুজাহিদিন জঙ্গি অমরনাথ যাত্রার প্রস্তুতি বানচাল করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সিআরপিএফ তিনজনকেই খতম করে। এর মধ্যে মোহমদ আশরাফ নামের একজনের মাথার দাম ছিল ২৫ লাখ টাকা। তাই তিনবছর পর, বিশেষ করে ৩৭০ ধারা বিলোপ শেষে দেশের অন্যতম সেরা তীর্থযাত্রা নিষ্কণ্টক করতে মরিয়া খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বস্তুত এই কারণে এখনই শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁও, চন্দনবাড়ি, পিশুটপ, পঞ্চতরণী, সবর্ত্রই সার দিয়ে সিআরপিএফ মোতায়েন করা হয়ে গিয়েছে। প্রতিটি ব্রিজ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সব জায়গায় এখনই দেখছি, পজিশন নিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। পর্যটকের গাড়িও যেখানে সেখানে তল্লাশি চলছে।
আসলে সবার মনে ঘুরছে ২০০০ সালে পহেলগাঁওতে তীর্থযাত্রীদের শিবিরে এবং ২০১৭ সালে পুণ্যার্থী বোঝাই বাসে জঙ্গি হানা হয়েছিল। প্রথমটিতে ৩০ এবং বাসে হামলার ঘটনায় ৮ জন তীর্থযাত্রী মারা যান। বস্তুত এই কারণে নজরদারি নিখুঁত করতে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিটি দেওয়া হচ্ছে সমস্ত তীর্থযাত্রীদের। ড্রোন দিয়ে যাতে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে অমরনাথ যাত্রা বানচাল না করতে পারে সে জন্য স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যাবহার করছে সেনারা। লেজার প্রযুক্তির নানা সেন্টার এখনই বসে গিয়েছে পাহাড়ের ঢালে ও উপত্যকা জুড়ে। এখন দেখা, শুধু ঘোড়াই হাসবে, না তীর্থযাত্রা শেষে কয়েক লক্ষ পুণ্যার্থী ভক্তিভরে সরকারকে আশীর্বাদ করেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.