মণিশংকর চৌধুরি, লামডিং: ওঁরা অন্যরকম। পুরুষ-নারীর বাদানুবাদের মধ্যে অন্যরকম ওঁদের পৃথিবী। তৃতীয় স্বত্ত্বার ওই মানুষগুলি এখন অস্তিস্তের খোঁজে। তৃতীয় লিঙ্গে জন্ম নেওয়াটা যেন পাপ, অন্তত ছোটবেলা থেকে মা-বাবার কাছে এমনটাই শিখে এসেছেন তাঁরা। তাই, বাবা-মায়ের পরিচয়ের বাইরে আলাদা নিজেদের পরিচয় তৈরি করে নিতে চাই অসমের কিন্নর সমাজ। ভোটের মরশুমে তাদের দাবি, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য আলাদা নাগরিকপঞ্জী তৈরি করতে হবে। নাগরিকপঞ্জির সেই তালিকায় তাদের পরিচয় হবে, শুধু নিজের নামে। বাবা-মায়ের পরিচয় দেওয়ার কোনও প্রয়োজন থাকবে না। সেই সঙ্গে চাই ভোটাধিকার।
কথা হচ্ছিল পিংকির সঙ্গে। এখন তিনি কিন্নর সমাজের অন্তর্ভুক্ত। আসল নাম সফিকুল। অসমের করিমগঞ্জের বাসিন্দা তিনি। পিংকি জানাচ্ছিলেন, যখন বছর ১০-১২ বয়স তখনই বাড়ির লোক টের পেয়ে যায় তাঁর মধ্যে অন্য স্বত্ত্বা কাজ করছে। তারপর থেকেই বাবা-মায়ের অবহেলার শিকার হন তিনি। আসলে, বাবা-মাকেও সমাজের চোখে নিকৃষ্ট জীব হিসেবে দেখা হত। যার ফলে, অবহেলিত হতে হত সফিকুলকে। একটা সময়ের পর সে আর নিজের এবং নিজের বাবা-মায়ের অপমান সহ্য করতে পারেনি। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। ধুবুড়ির বছর আঠাশের খুশবুর গল্পটাও অনেকটা এরকমই। তিনিও বাড়ি ছাড়েন ১০-১২ বছর বয়সেই। তারপর কিন্নর সমাজের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, এবং এখনও সেই সমাজের অধিকারের জন্যই কাজ করে চলেছেন।
আসলে, ওরা সমাজের সব ক্ষেত্রেই অবহেলিত। বাবা-মা পরিচয় দিতে লজ্জা পান। নিজেরাও রাস্তায় বেরলে শুনতে হয় কূকথা, কটূক্তি কিংবা কটাক্ষ। এসবের বাইরে তাই ওরা এবার নিজেদের পরিচয় চাইছে। দাবি, মূলত তিনটে। আলাদা এনআরসি চাই। যাতে শুধুমাত্র তাদের নাম থাকবে, বাবা-মায়ের পরিচয়ের দরকরা হবে না। দ্বিতীয় ভোটাধিকার চাই। রাষ্ট্রহীন হয়ে থাকার যন্ত্রণা ভূগতে ভোটাধিকার যে কতটা প্রয়োজনীয় তা বুঝতে পেরেছেন তাঁরা। তৃতীয় দাবিটিও বড্ড সমীচিন। পুরুষ বা মহিলা নয়। লিঙ্গের জায়গায় ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ লেখার অধিকার চান তাঁরা। ইতিমধ্যেই অল অসম কিন্নর সমাজ এই দাবিগুলি নিয়ে সরব হয়েছে। তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারও করছে।
কিন্নর সমাজের এই দাবিগুলির প্রথম পর্যায় মেনে নেওয়া কাজ শুরু হয়েছে। এবছর অসমের মোট ৫০৩ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ভোটাধিকার পেয়েছেন। কিন্তু না পাওয়ার তালিকাটাও দীর্ঘ। অসমের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার বিচারক স্বাতী বিধান বড়ুয়া জানান, কিন্নর সমাজের মোট ১১ হাজার মানুষ ভোটার তালিকায় নাম তুলতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাদের অনেকেই নথিপত্র জমা দিতে পারেননি। কারণ, সমস্ত নথিপত্র জোগাড় করা সত্যি কষ্টসাধ্য। আসলে, যাদের পিতৃপরিচয়ই নেই তাঁরা আবার কী করে কাগজপত্র জোগাড় করবেন? তিনসুকিয়া, ডিব্রুগড়, নগাঁও, শিবসাগর, জোড়হাট জেলাগুলিতে প্রায় ২০ হাজার কিন্নরের বাস। তাদের সকলেরই দাবি, নাগরিকত্ব এবং ভোটদানের অধিকার। কবে, পূরণ হবে? কে জানে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.