বিশ্বদীপ দে: তিনি ‘ভারতের জেমস বন্ড’। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্রের ‘ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই’ নয়, মগজাস্ত্রের অব্যর্থ প্রয়োগেই কিস্তিমাত করে বিপক্ষকে মাটি ধরিয়েছেন ‘ভারতের টপ স্পাই মাস্টার’। গত দুই পর্বে আমরা দেখেছি কীভাবে মিজোরাম, সিকিম, কাশ্মীর, পাঞ্জাব- একে একে বিভিন্ন রাজ্যের জটিল সমস্যার মোকাবিলা করেছিলেন অজিত ডোভাল। আজ তিনি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। এহেন এক মানুষের জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ‘জার্নি’ কিন্তু পাকিস্তানেই। এক, দুই নয় সাত-সাতটি বছর তিনি কাটিয়েছিলেন প্রতিবেশী দেশে। সেখানে তাঁর ‘কীর্তি’ আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। যা গল্পকথাকে হার মানানোর মতো। অবশ্য ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’ কথাটা তো আর এমনি এমনি বলা হয় না!
‘একবিংশ শতাব্দীর চাণক্য’ পাকিস্তানে (Pakistan) দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন ছদ্মবেশে। ধর্মপ্রাণ মুসলমান সেজে বসে থেকেছেন ধর্মস্থানে। কখনও ভিখারি সেজে পথের ধারে ভিক্ষা করতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। আর এসব করতে গিয়ে ধরাও পড়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব বিপদকে তিনি তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি দিয়েই উড়িয়ে দিয়েছেন ডোভাল। প্রথমে সেই গল্প।
পাকিস্তানের হাই কমিশনে বছর ছয়েক ছিলেন তিনি। আর একটা বছর তাঁকে কাটাতে হয়েছিল অজ্ঞাতবাসে।
সেই সময়ই একদিন লাহোরের এক মাজারে ঘটল এক ঘটনা। উর্দু বলতে ও পড়তে পারতেন ডোভাল (Ajit Doval)। পরনে থাকত আর পাঁচজন সাধারণ মুসলমানের মতো পোশাক। ফলে সাদা চোখে দেখলে সন্দেহ করার মতো কিছুই ছিল না। কেউ করেওনি। কিন্তু একদিন মাজারের বাইরে বসা এক বৃদ্ধ মৌলবী তাঁকে সটান বলে বসলেন, ‘তুমি হিন্দু।’ শুনে চমকে ওঠেন ডোভাল। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সেই বৃদ্ধ তাঁকে নিয়ে যান নিজের ছোট্ট আশ্রয়ে।
সরু গলির ভিতরে সেই ঘুপচি ঘরের দরজা বন্ধ করে ওই ভদ্রলোক জানান, ডোভালের কানে ছিদ্র রয়েছে। যা হিন্দুদেরই থাকে। আসলে অজিতের বেড়ে ওঠা উত্তরাখণ্ডের যে গ্রামে, সেখানে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে শিশুদের কানে ফুটো করার প্রচলন ছিল। বৃদ্ধের কথা এড়াতে পারা সম্ভব ছিল না ডোভালের পক্ষে। তবে চেষ্টা করেছিলেন নিজেকে মুসলমান হিসেবে প্রমাণ করার। কিন্তু শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, তিনি হিন্দুই। এরপর তাঁকে অবাক করে ওই মৌলবী জানান, তিনি এটা সহজেই ধরতে পারলেন, কেননা তিনিও হিন্দু! গোপনে আলমারির ভিতরে রাখা শিব ও দুর্গার ছবিও দেখান ডোভালকে। জানান, তাঁর মা-বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। তিনি নিজেকে বাঁচাতে এই ছদ্মবেশ ধারণ করে দিন গুজরান করছেন। রীতিমতো শ্রদ্ধা উদ্রেককারী সাদা দাড়িওয়ালা মানুষটি যে আদতে অজ্ঞাতবাসে রয়েছেন, তা দেখে অবাক হয়েছিলেন ডোভাল। বয়স্ক মানুষটি তাঁকে পরামর্শ দেন, অস্ত্রোপচার করে কানের ফুটো বুজিয়ে ফেলতে। অন্যথায় তাঁকে সমস্যায় পড়তে হবে বলে সতর্কও করে দেন। একটি ভিডিওয় নিজেই সেই গল্প শুনিয়েছিলেন ‘সুপার কপ’।
পাকিস্তানে ডোভালের সবচেয়ে বড় সাফল্য কী? এইবার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। ১৯৭২ সালে ভারত বিশ্বকে চমকে দিল প্রথম পরমাণু পরীক্ষা করে। এই পরীক্ষা সফল হতেই পাকিস্তান যেন ছটফট করতে শুরু করল। ড. এ কিউ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের বিজ্ঞানীরা তেড়েমেড়ে বোমা বানানোর চেষ্টা শুরু করলেন। উত্তর কোরিয়া ও ‘বন্ধু চিনে’র সাহায্যে এগোতে শুরু করল গবেষণা। এদিকে খবর পৌঁছে গেল নয়াদিল্লিতে। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর গুপ্তচরদের নিয়োগ করলেন চিন ও পাকিস্তানে। সেই স্পাইদেরই একজন অজিত ডোভাল।
সেই সময় পাক মুলুকের কাহুতা শহরের পথে এক ভিখারির উদয় হল। বলাই বাহুল্য, তিনিই ডোভাল। সেখানে অবস্থিত ‘খান রিসার্চ সেন্টারে’র ভিতরে চলছিল গোপন গবেষণা। কাকপক্ষীও টের পায়নি, কী ঘটছে সেখানে। কিন্তু ভারতের কাছে খবর চলে এসেছিল। আর তাই সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসলেন ডোভাল। নজরদারি শুরু করলেন খান রিসার্চ সেন্টারে কারা আসছেন, কারা যাচ্ছেন সেদিকে। উদ্দেশ্য, সত্যিই সেখানে তেমন কিছু হচ্ছে কিনা সেব্যাপারে নিঃসংশয় হওয়া। কিন্তু ব্যাপারটা ফলপ্রসূ কিছু হচ্ছিল না। আচমকাই ডোভালের মাথায় আসে একটা অন্য কথা। তিনি দেখেছিলেন পাক বিজ্ঞানীরা অনেকেই একটি সেলুনে গিয়ে চুল-দাড়ি কাটাতেন।
অমনি অন্য পরিকল্পনা করে ফেললেন ডোভাল। তিনি সেই সব চুলের নমুনা ভারতে পাঠালেন গোপন সূত্র ব্যবহার করে। পরীক্ষায় দেখা গেল, সত্য়িই সেই চুলগুলি পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার চিহ্ন বহন করছে। ব্যাস! মিলে গেল প্রমাণ। এরপর নানা কৌশলে সেই গবেষণার বহু তথ্যও জোগাড় করেন ডোভাল। পাঠিয়ে দেন ভারতে। যেভাবে প্রায় একা হাতে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন ডোভাল, তা আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। কেবল পরমাণু গবেষণাই নয়, পাকিস্তানের মাটিতে আইএসআই ও পাক প্রশাসনের মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করতে পেরেছিলেন ডোভাল। তাঁর এহেন সব কীর্তির কারণেই পাকিস্তান আজও রীতিমতো ভয় করে আশি ছুঁইছুঁই মানুষটির ক্ষুরধার মস্তিষ্ককে।
২০০৫ সালে তিনি অবসর নিলেও আমরা জানি মোদি সরকারের (Modi Government) শুরু থেকেই তিনি দায়িত্ব পান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হওয়ার। ৩০ মে, ২০১৪ সালে দায়িত্ব পাওয়ার কয়েক মাস পরেই ইরাকে ৪৬ জন নার্স অপহৃত হন। আইসিস তাঁদের অপহরণ করেছিল। এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে ডোভালকেই ভরসা করেছিল ভারত। এবারও নিরাশ করেননি তিনি। সোজা ইরাকে পৌঁছে কূটনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করে দেশে ফিরিয়েছিলেন সেই নার্সদের। এই প্রসঙ্গে অনেকের মনে থাকতে পারে ১৯৯৯ সালের মিশন কান্দাহারের কথা। ৫ জন হরকতুল মুজাহিদিন জঙ্গি অপহরণ করেছিলেন একটা গোটা বিমান। আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেটিকে। শেষ পর্যন্ত অপহরণের প্রায় ১৭৩ ঘণ্টা পরে উদ্ধার পান অপহৃত যাত্রীরা। আর তাঁদের এই উদ্ধার পাওয়ার পিছনেও ছিল ডোভালের সুকৌশলী মস্তিষ্কই।
ডোভালকে নিয়ে গল্প শেষ হওয়ার নয়। তবে তাঁর সাম্প্রতিক কীর্তির কথা অনেকেরই জানা। বিশেষ করে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো বহুচর্চিত বিষয়। যা নিয়ে ছবিও হয়েছে। তাই সেসব নয়, তিন পর্বের এই লেখায় আমরা ফিরে দেখলাম অপেক্ষাকৃত পুরনো ঘটনাগুলি, যা বুঝিয়ে দেয় কোন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পরে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি, ‘ভারতের জেমস বন্ড’ অজিত ডোভাল।
(সমাপ্ত)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.