কৃষ্ণকুমার দাস, নর্মদা: স্বাধীনতার পর মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার অভিযোগ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর দায়ে আরএসএস-কে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করেছিলেন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। কিন্তু সেই আরএসএস-এর অন্যতম প্রচারক থেকে বিজেপির দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হয়ে কেন তিনি সেই প্যাটেলেরই বিশ্বের ‘উচ্চতম’ মূর্তি গড়লেন? কৃষকরা বিদ্রোহ করলেও তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করে কেন এক প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতির মূর্তি গড়া হল? কেন মূর্তি প্রকল্প শেষের পরও এবার বিলাসবহুল গেস্ট হাউস, প্রমোদনগরী ও রিসর্ট প্রকল্পে আদিবাসী ও ভিল সম্প্রদায়ের জমি দ্বিতীয় দফায় দখলের নির্দেশ? তবে কেন আরেক গুজরাটি গান্ধীর মূর্তি হল না? প্রশ্ন কংগ্রেস সাংসদ আহমেদ প্যাটেলের।
দক্ষিণ গুজরাটের নর্মদা জেলার সভায় এমনই অজস্র বাস্তব প্রশ্ন তুলে বিজেপিকে জোর চেপে ধরেন এলাকার ভূমিপুত্র কংগ্রেস সাংসদ আহমেদ প্যাটেল। প্রাক্তন ক্রিকেটার নভজ্যোৎ সিং সিধু-কে নিয়ে রাত ন’টায় বরোদা-নর্মদা হাইওয়ের পাশের ওয়াধিয়া জনপদে পৌঁছান। আগে থেকেই হাজার পাঁচেক লোকের জমায়েত ছিল। কিন্তু আহমেদ এসে পৌঁছতেই মিনিট খানেকে জমায়েত দ্বিগুণ! মুম্বই হামলায় জঙ্গিরা গুজরাটের সমুদ্র পেরিয়ে গিয়েছিল বলে তোপ দাগেন তিনি। বলেন, “তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদি। তিনি দায় নেননি। এখন সাধ্বী প্রজ্ঞা নামে যাঁকে ভোপালে প্রার্থী করা হয়েছে, সে মালেগাঁও বিস্ফোরণের আসামী। একজন জঙ্গিকে প্রার্থী করেছে বিজেপি।” এরপরই সোজা চলে এলেন নর্মদা ইস্যুতে। বললেন,“আদিবাসী, ভিল উপজাতিদের জমি জোর করে কেড়ে নেওয়ার খেসারত দিতেই হবে বিজেপিকে।”
প্যাটেলের মূর্তি নিয়ে সোনিয়ার সচিবের মন্তব্য, “একজনের শখ মেটাতে, বিজেপির স্বার্থ দেখতে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ হল। এখন বিলাসবহুল বাংলো ও প্রমোদক্ষেত্র বানাতে জোর করে পুলিশ দিয়ে জমি নিচ্ছে রূপানি সরকার।” এরপরই সটান প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে কংগ্রেসের সেনাপতি বলেন, “আগে রাজ্যে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় ছিলেন, গুজরাতের ক্ষতি করেছেন। আর এখন দেশের ক্ষতি করছেন, ১২৫ কোটি ভারতবাসীকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন। বছরে দু’কোটি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে পাঁচ বছরে ২ কোটি মানুষকে কর্মহীণ করেছেন।”
নামে নর্মদা সরোবর হলেও আসলে ভারুচ ও ছোটা উদয়পুর, দুই লোকসভা আসনের বিভিন্ন বিধানসভা জুড়ে পুলিশ দিয়ে জোর করে জমি দখলের ইস্যু প্রধান হয়ে উঠেছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ইস্যু যেমন ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে জোরালো হয়েছিল, তেমনই ক্ষোভ দানা বেঁধেছে নর্মদার চারপাশে। যেখানে মূর্তি গড়া হয়েছে তার নিচে একসঙ্গে ১২টি জেসিবি নামিয়ে শুকনো খটখটে নদীর ভিতরে পাথর কাটা চলছে। ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’র কাছে দাঁড়িয়ে যে ছবি ক্যামেরা-বন্দি করা হয়, তাতে যেমন সর্দার প্যাটেল আছেন তেমন রয়েছে নর্মদার ভিতরে পাথর কাটার কাজ। বাঁধ প্রকল্পের জেরে নর্মদার বুকে মাছ তো দূরের কথা, জল না থাকায় বন্ধ চাষও।
গাডুদেশ্বর গ্রামে অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখা মেলে জমি বাঁচাতে লড়াই করা দাপুটে আদিবাসী নেতা লক্ষ্মণ মাসাবার। জনা ১২ ভিল উপজাতি যুবক-প্রৌঢ় নিয়ে ভোট-পরবর্তী আন্দোলন নিয়ে গোপন শলায় ব্যস্ত তিনি। প্রতিশ্রুতি মতো জমিদাতাদের এখনও চাকরি দেয়নি গুজরাত সরকার। তবে এবার নতুন করে আরও কয়েক হাজার একর জমি নিচ্ছে বিজয় রূপানির সরকার। লক্ষ্য, ওই নতুন জমিতে বিভিন্ন প্রদেশের ভবন হবে, গড়ে উঠবে এক নতুন প্রমোদ নগরী। এই কর্মসূচিতে হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর যেদিন আসেন, সেদিন কয়েক হাজার উপজাতি ভিল ও আদিবাসী জঙ্গি বিক্ষোভ দেখায়।
কলকাতা থেকে আসা বাঙালি সাংবাদিক, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলন ও জমি বাঁচানোর লড়াই দেখেছি শুনে পাল্টা নানা প্রশ্ন করলেন। লক্ষ্মণ বললেন, “৩০ বছর ধরে নর্মদা নিয়ে আন্দোলন করা মেধা পাটেকরের লড়াইয়ের ধার কমে গিয়েছে। এখানে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের চাই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের নেত্রী মমতাদিকে।” মমতাই মোদির ‘বিকল্প’ বলে দাবি করলেন লক্ষ্মণ। উলটোদিকে লক্ষ্মণ তথা কংগ্রেসের এই অভিযোগ মিথ্যা- দাবি রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র ভরত পাণ্ডিয়ার।
ভারুচ থেকে টানা তিনবার জেতা আহমেদ প্যাটেল শেষ জিতেছিলেন ১৯৮৪ সালে। গত ৩০ বছরে গুজরাট থেকে আর কোনও মুসলিম সাংসদ ভোটে জিতে লোকসভায় পা রাখেননি। এবারও বিতর্কিত নর্মদা বাঁধ সংলগ্ন ভারুচে কংগ্রেস প্রার্থী করেছে সংখ্যালঘু আবদুল সুকুর পাঠানকে। গুজরাটের সর্বাধিক মুসলিম ভোটার এই ভারুচে। ২২.২ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটার আহমেদ প্যাটেলদের সঙ্গে। প্রায় পাঁচ লক্ষ আদিবাসীর মধ্যে ভিল সম্প্রদায়ের। বিজেপির বর্তমান সাংসদ মনসুখভাই বাসাবা ফের চতুর্থবার সংসদে পৌঁছাতে ভোটে প্রার্থী হয়েছেন। কংগ্রেসের কাছে টিকিট না পেয়ে ভিল সর্দার ছোট ভাইও প্রার্থী হয়ে কংগ্রেসের
অস্বস্তি বাড়িয়েছে।
সর্দার প্যাটেলের মূর্তি দেখে ফেরার পথে ‘প্যাটেল স্মৃতিরক্ষা কমিটি’-র কর্মকতা রাজুভাইয়ের কাছে প্রধানমন্ত্রীর সুউচ্চ মূর্তি তৈরির রহস্য জানতে চাইলে, তিনি বললেন, “গান্ধী বা নেহরুর মতো আরএসএস বা বিজেপির ‘জাতীয় নেতা’ হতে পারেন এমন কোনও আইকন নেই। আর সুভাষ বসু বাঙালি, তাঁর উত্তরাধিকারী মমতার দলের সাংসদ। তাই গান্ধীহত্যার দায়ে আরএসএসকে তিনি নিষিদ্ধ করলেও দেশের প্রথম উপ প্রধানমন্ত্রী, তথা একজন গুজরাটি হিসাবে প্যাটেলকে তুলে ধরলে বাইরে না হলেও নিজের রাজ্যে ভোটে কিছুটা সুবিধা হবে।”
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.