কুণাল ঘোষ: কেন্দ্রীয় সরকার সেনাবাহিনীতে ‘অগ্নিপথ’ স্কিম (Agnipath Scheme) আনতে চাইছে। চার বছরের চুক্তিতে নিয়োগ। এই স্কিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে দেশজুড়ে। উলটোদিকে বিজেপি কখনও বলছে, চার বছর পর একজন তরুণের পুঁজিতে অনেকটা টাকা থাকবে; কখনও তাদের কোনও নেতা বলছেন, চার বছর পর তাদের বিজেপি (BJP) দপ্তরগুলিতে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ দেওয়া হবে। এই ধরনের চর্চাগুলির মধ্যেই প্রতিরক্ষা মহল সূত্রে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা মনে করছেন, এই স্কিম সেনাতে বড় বিপদ তৈরি করে দেবে। এর কারণগুলি হল –
১) কর্মসংস্থানগত সমস্যা: চার বছর পর এতগুলি তরুণ কী করবেন? কোথায় যাবেন? সেনার সংখ্যা ঠিক রাখতে গিয়ে চক্রাকারে কয়েকজন কর্মচ্যুত তরুণ-তরুণী তৈরি হবে। পেনশন তহবিলের আর্থিক বোঝা এড়াতে এই বিকল্প ফরমুলায় সমাজে হিতে বিপরীত হবে।
২) প্রশিক্ষণগত সমস্যা: সেনাসূত্র বলছে, দু’বছরে সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণ অসম্ভব। এটা জোড়াতালির কাজ হচ্ছে। একজন সেনা জওয়ানকে সঠিকভাবে তৈরি করতে যে সময় লাগে, যতদিনে তাকে আধুনিক অস্ত্র ধরার উপযোগী করা হয়, তা এই ক্ষেত্রে অসম্ভব। তাছাড়া যতটাই প্রশিক্ষণ হবে, সেই সরকারি খরচ শুধু চার বছরের জন্য? তারপর আবার নতুন একজনকে তৈরির খরচ? এটা বাস্তবসম্মত হতে পারে না।
৩) নিরাপদে থাকার মানসিকতা: পুরোদস্তুর সেনার চাকরিতে প্রশিক্ষণ থেকে কর্মজীবন, একটি নির্দিষ্ট মানসিকতা থাকে। ঝুঁকি নিয়েও লড়াই হয়। কিন্তু চার বছরের চুক্তিসেনায় ‘প্লে সেফ’ মানসিকতা কাজ করবে। নিরাপদে থেকে সময়টুকু কাটিয়ে দেওয়া। এটা সেনাবাহিনীর ভিত নড়িয়ে দেবে।
৪) গুণগত মান: যে তরুণ-তরুণীরা পুলিশ বা সেনা বা এই ধরনের কাজে আগ্রহী, তাঁরা মূলত পুরো সময়ের স্থায়ী চাকরিকে অগ্রাধিকার দেবেন। দীর্ঘ সময়ের চাকরি পেলে সেখানেই যাবেন। যাঁরা পাবেন না, তাঁরা এই ‘অগ্নিপথ’ স্কিম নিতে পারেন। ফলে গুণগত মান নিয়ে আশঙ্কা থাকছে।
৫) বন্ডিং থাকবে না: সেনাতে প্রশিক্ষণ থেকে কর্মজীবন, পরস্পরের মধ্যে একটি বন্ডিং বা ভ্রাতৃত্ববোধের মানসিকতার বন্ধন গড়ে ওঠে। একে অপরের সঙ্গে কাজের বোঝাপড়া, আক্রমণের কৌশল, পরস্পরকে বাঁচাতে জান কবুল – এগুলো ‘অগ্নিপথ’-এর চার বছরের চুক্তিসেনায় ভাবাটাই হাস্যকর। ফলে সেনার স্পিরিটে অসঙ্গতি থাকবে। তাছাড়া পূর্ণ চাকরির সম্পূর্ণ সেনা এবং চুক্তিসেনার ‘প্লে সেফ’ কাজের সহাবস্থান পূর্ণ সেনার মানসিকতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তেলে জলে মিশ খাওয়া কঠিন। পূর্ণ সেনার মানসিকতা ও শৃঙ্খলাবোধ, দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পুঁজির উলটোপথে থাকবে চার বছরের চুক্তিসেনা। ইথোস বা বৈশিষ্ট্যভিত্তিক সমীকরণেও ভারসাম্য টাল খেতে পারে।
৬) প্রশিক্ষিত সেনার হতাশাজনিত সামাজিক সমস্যা: পূর্ণ প্রশিক্ষণ হোক বা না হোক, সেনার বৃত্তে কিছু প্রশিক্ষণ তো হবেই। সেনার সঙ্গে থাকার মেজাজটাও আসবে। কিছু কৌশল রপ্ত হোক বা নাই হোক, জানা বা শোনা হবে। চারটি বছর পর যদি এরকম একঝাঁক প্রশিক্ষিত ও সেনাকৌশল কিছুটা জানা তরুণ কর্মচ্যুত হয়ে মানসিক অবসাদে ভোগে এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তার পরিণাম কী হতে পারে, বিষয়টা যথেষ্ট উদ্বেগের।
আমরা কিছু তরুণকে কিছুটা সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছু টাকা-সহ সমাজে ছেড়ে দিচ্ছি। যারা বিকল্প চাকরি পাবে, সমস্যা নেই। কিন্তু বাকিরা? আজকের জীবনযাত্রায় ওই টাকা কমতে সময় লাগবে না। সাধারণ জনতার বিক্ষোভ সামলাতেই পুলিশ নাজেহাল হয়, আর সেই ভিড়ে যদি থাকে এরকম কিছু প্রশিক্ষিত তরুণ? বা, কোনও শক্তি যদি তাদের বিপথে প্ররোচিত করে? অল্প বয়সে সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় থাকা তারুণ্যের হতাশাজনিত পদক্ষেপ সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের থাকবে তো?
ফলে রাজনৈতিক চাপানউতোরের বাইরেও ‘অগ্নিপথ’ স্কিম সেনাবাহিনীতে সুদূরপ্রসারী বিপদ ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করছে প্রতিরক্ষা (Defence) বা স্বরাষ্ট্র দপ্তর সংশ্লিষ্ট একাধিক মহল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.