বিশ্বদীপ দে: আর জি কর। শিক্ষানবিশ তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল বাংলা। রেশ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশেই। এই নিয়ে যে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা চলেছে সুপ্রিম কোর্টে, সেখানে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের মন্তব্যে উঠে এসেছে পাঁচ দশকের আগের আর এক ভয়ংকর ঘটনার দুঃস্মৃতি। স্বাস্থ্য পরিষেবায় যুক্ত মহিলাদের প্রতি হওয়া হিংসা প্রসঙ্গেই আর জি কর প্রসঙ্গে তিনি তুলে ধরেছিলেন অরুণা শানবাগের কথা। ১৯৭৩ সালে কুকুর বাঁধার চেন গলায় বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছিল তাঁকে। পরবর্তী ৪২ বছর কেটেছিল কোমায়! এই মর্মান্তিক পরিণতি আজও ভুলতে পারেনি দেশবাসী। আর তাই এদেশে নির্যাতিতাদের করুণ পরিণতি বার বার ফিরিয়ে আনে অরুণা শানবাগের সঙ্গে হওয়া নির্যাতনের ঘটনাকে।
মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারানো অরুণা রামচন্দ্রের জীবন ছিল স্ট্রাগলের। কর্নাটকের বছর চব্বিশের তরুণী নার্সিংয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন মুম্বইয়ের কিং এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হাসপাতালে। তাঁর বিয়ের কথাবার্তাও হয়ে গিয়েছিল। হবু বর ডাক্তার। ওই হাসপাতালেরই চিকিৎসক তিনি। কে জানত কোন ভয়াল ভবিষ্যৎ ঘাপটি মেরে পড়ে রয়েছে অন্তরালে।
১৯৭৩ সালের ২৭ নভেম্বর। সেদিনের মতো কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। পোশাক বদলাচ্ছিলেন তিনি। আচমকাই তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সোহনলাল ভরত বাল্মিকী। কে এই ভরত? সে ওই হাসপাতালেরই ওয়ার্ড বয়। আকস্মিক হামলায় সে অরুণার গলা বেঁধে ফেলে কুকুর বাঁধার চেন দিয়ে। তার পর ধর্ষণ করে। পরদিন সকালে উদ্ধার হয় অরুণার অচেতন রক্তস্নাত দেহ। হাসপাতালের এক ক্লিনার খুঁজে পান তাঁকে। কিন্ত ততক্ষণে কেটে গিয়েছে প্রায় আট ঘণ্টা। এই দীর্ঘ সময় গলায় চেনবন্দি হয়ে পড়েছিলেন অরুণা। ফলে মস্তিষ্কে পৌঁছয়নি রক্ত। পাশাপাশি মেরুদণ্ডের বিভিন্ন অংশেও ছিল চোট। যার জেরে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যান অরুণা। আর পরবর্তী চার দশকেরও বেশি সময় ছিলেন কোমাতেই। হাসপাতালের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বেডেই কেটে গিয়েছিল বাকি জীবনটা। দীর্ঘ, নিঃস্ব, রিক্ত এক কালখণ্ড এই পৃথিবীর বুকেই ছিলেন তিনি। কিন্তু চেতনায় আর ফেরা হয়নি।
কিন্তু কেন বাল্মীকি ধর্ষণ করেছিল অরুণাকে? এই প্রসঙ্গে পিঙ্কি ভিরানির (এই পিঙ্কিই পরবর্তী সময়ে অরুণার স্বেচ্ছামৃত্যুর আর্জি জানান।) একটি বই রয়েছে। ‘অরুণাজ স্টোরি: দ্য ট্রু অ্যাকাউন্ট অফ আ রেপ অ্যান্ড ইটস আফটারম্যাথ’ নামের সেই বই থেকে জানা যায়, বাল্মিকী নাকি হাসপাতালে মেডিক্যাল পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য যে কুকুরগুলি থাকত তাদের খাবার চুরি করত! সেটাই জানতে পেরে গিয়েছিলেন অরুণা। ধরিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন। এর পর থেকেই তাঁকে ‘টার্গেট’ করে ফেলেছিল বাল্মীকি।
বাল্মিকী অচিরেই ধরা পড়ে। সাজাও পায়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা ও চুরির অভিযোগ আনা হলেও ধর্ষণের অভিযোগ ছিল না। ফলে সাত বছর জেল খাটার পর সে মুক্তি পেয়ে যায়। তার পর থেকে তার আর খোঁজ মেলেনি। পিঙ্কির বই থেকে অবশ্য জানা যায়, ওই হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়দের দাবি ছিল বাল্মীকি নাকি নিজের পরিচয় বদলে দিল্লির এক হাসপাতালে চাকরি নিয়েছে। ধর্ষণের অভিযোগ না থাকায় দীর্ঘ শাস্তিভোগ থেকে বেঁচে গিয়ে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেল। অথচ অরুণা?
কিন্তু কেন ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়নি? মেডিক্যাল পরীক্ষায়, যা ‘ফিঙ্গার টেস্ট’ নামে পরচিত, তাতে দেখা যায় সতীচ্ছদ অক্ষত ছিল অরুণার। অচেতন তরুণীর সঙ্গে পায়ুকামে লিপ্ত ছিল ঘৃণ্য ধর্ষক। কিন্তু বিষয়টি আদালত পর্যন্ত পৌঁছয়নি। জানা যায়, অরুণার বাগদত্ত জুনিয়র ডাক্তারের মনে হয়েছিল, ধর্ষণের অভিযোগ থাকলে অরুণার সম্মানহানি হবে! তিনি কোনও অভিযোগই আনেননি। ফলে রায়ের সময় বলা হয়েছিল ‘ধর্ষণের উদ্দেশ্যে’ বাল্মিকী ওখানে গিয়েছিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ছিল না। তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় খুনের চেষ্টা ও চুরির (একটি ঘড়ি ও অরুণার কানের দুল চুরি করেছিল সে) অভিযোগে।
অরুণার বাগদত্তর আশা ছিল, একদিন কোমা থেকে ফিরে আসবেন তাঁর হবু স্ত্রী। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা হয়নি। একসময় ওই তরুণ বিয়ে করেন। চলে যান বিদেশে। কিন্তু এত সব ঘটনাচক্রের সমান্তরালে অরুণার স্থান ছিল সেই ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বেড। দশকের পর দশক বিছানায় অচেতন পড়ে থাকাই ছিল হতভাগ্য সেই তরুণীর ভবিতব্য। তবে তাঁর দেখভালে কোনও ত্রুটি ছিল না। ডাক্তার থেকে নার্স- সকলেই নজরে রাখতেন অরুণাকে। টিউবে খাওয়ানোর পাশাপাশি নিয়মিত পরিষ্কার করানো হত তাঁকে। তাই অতগুলো বছর শয্যাশায়ী থেকেই ‘বেডসোর’ হয়নি। সাংবাদিক সাগরিকা ঘোষের মতে, এই নার্সরাই ‘প্রকৃত ভারতরত্ন’, যাঁরা কখনও অরুণার প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করেননি।
তবুও হতচেতন অরুণার পরিস্থিতি তাঁর কাছের মানুষদের দারুণ ভাবে নাড়া দিত। অনেকেরই মনে হয়েছিল, এবার নিষ্কৃতি দেওয়া হোক তাঁকে। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টে পিঙ্কি ভিরানির আর্জি ছিল, খুলে দেওয়া হোক অরুণার লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম। যাতে ত্বরান্বিত হয় তাঁর মৃত্যু। কার্যতই এটা ছিল ইউথেনেশিয়া তথা স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন। যেহেতু অরুণা ছিলেন সংজ্ঞাহীন। তাই পরোক্ষে তাঁর হয়ে আবেদন করেছিলেন পিঙ্কি। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য সেই আর্জি মানেনি। তা খারিজ হয়ে যায়। তবে শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, পরোক্ষে স্বেচ্ছামৃত্যুকেও আইনের আওতায় আনার প্রয়োজন রয়েছে। এর পর ২০১৫ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কোমা-জীবন শেষ হয় অরুণার। এই দীর্ঘ যন্ত্রণার পরও তিনি ন্যায় পাননি। এমন ঘৃণ্য অপরাধের পরও মাত্র সাত বছরের সাজা পেয়েছিল বাল্মিকী। এর ছগুণ সময় হাসপাতালের বিছানায় কেটে গিয়েছিল অরুণা শানবাগের। চেতনার থেকে দূরে, যন্ত্রণাময় ছায়াচ্ছন্ন অচেতন অবস্থায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.