মলয় কুণ্ডু, পাটনা: গত পাঁচদিন ধরে কিছুতেই তাঁর পাত্তা মিলছিল না। প্রথমে লখনউতে স্ত্রী পুনম সিনহার প্রচারে ব্যস্ত। পাটনায় এসেই ফের দিল্লি চলে যাওয়া। সেখান থেকে ফিরে কদমকুঁয়ার পৈতৃক বাড়িতে পারিবারিক কাজ। ফের প্রচারে উত্তরপ্রদেশ। গত শুক্রবার মনোনয়নপত্র জমা দেবেন বলেও শেষ মুহূর্তে বাতিল। রবিবার সকালে জানা গেল, তিনি পাটনায় এসে গিয়েছেন। সোমবারই জমা দেবেন মনোনয়ন। তার আগে এদিন দুপুরে যাচ্ছেন গুরুদ্বার আর মন্দিরে। আগেই ফোনে ব্যক্তিগত সচিব অন্তত পাঁচবার জানিয়েছেন, শত্রুঘ্নজি ভীষণ ব্যস্ত। কথা বলা মুশকিল। তাই গা-জ্বালানো তপ্ত দুপুরে মাঝপথেই তাঁকে পাকড়াও করতে হল।
দুধসাদা স্করপিওর সামনের আসনে চেক শার্ট-কালো প্যান্ট, চোখে বাদামি সানগ্লাসে বসে থাকা শত্রুঘ্ন সিন্হার মুখে হাসি ফুটল তখনই, যখন আমার বাঙালি টানে হিন্দি উচ্চারণ শুনে ‘খামোশ’ তো বললেনই না, উলটে বিহারিবাবু জিজ্ঞাসা করলেন,“কোথা থেকে তসরিফ নিয়ে আসছেন?” বললাম, ‘কলকাতা।’ সটান দু’হাত তুলে একগাল হাসি নিয়ে বললেন, “নমস্কার। কলকাতায় তো আমি মাঝেমধ্যেই যাই। বাঙালিরা আমাকে খুব ভালবাসে। আর মমতাদিদি আমাকে ভীষণ পছন্দ করেন।” অনুষ্ঠান সেরে গাড়িতে বসে পড়েছিলেন পাটনা সাহিবের কংগ্রেস প্রার্থী শত্রুঘ্ন। কিন্তু ততক্ষণে কলকাতা নামমাহাত্ম্যে বরাতজোরে হাফ কাচ পুরোটাই নেমে গিয়েছে! বলে চলেছেন শত্রুঘ্ন, “মমতাদির যা জনসমর্থন আছে, তাতে অন্য কোনও দল আপনার রাজ্যে লড়াইয়ে টিকবে না। আমার কথা মিলিয়ে নেবেন।”
তাহলে আপনি ওয়েস্টবেঙ্গল থেকে দাঁড়ালেন না কেন? উনি তো আপনাকে অনুরোধও করেছিলেন? “ওনাকে এ জন্য ধন্যবাদ। আমি কৃতজ্ঞ। মমতাদি একজন গ্রেট লেডি, আমার গ্রেট ফ্রেন্ড। সতি্যই উনি চেয়েছিলেন আমি ওয়েস্ট বেঙ্গলের কোনও সিট থেকে প্রার্থী হই। কিন্তু আমি পাটনার কাছে বচনবদ্ধ রয়েছি, সিচুয়েশন যা-ই হোক লোকেশন এটাই হবে। তাই আমার কথা রক্ষা করার জন্য আমি পাটনার মানুষ ও বিহার পরিবারের কাছে চলে এসেছি।” কিন্তু ওয়েস্ট বেঙ্গলে দাঁড়ালে তো অনেক ‘সেফ সিট’ হত? “আই অ্যাম সো গ্রেটফুল টু হার। কিন্তু আমি এখানে কথা দিয়ে দিয়েছিলাম। এখন আমি দেখছি পুরো বেঙ্গল একজোট হয়ে মমতাকে সমর্থন করছে। সবাই তাঁরই সাপোর্টার। সঠিক অর্থে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন আয়রন লেডি, সবথেকে জনপ্রিয় লেডি। তিনি ভীষণ ভাল কাজ করছেন। আমি তাঁর সাফলে্যর জন্য শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।” বিরোধীরা জিতলে কি উনিই হবেন প্রধানমন্ত্রী? “দেখুন, সবাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য নেতা-নেত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ্য। মায়াবতী-অখিলেশও। রাহুল গান্ধীর নামও থাকছে। মমতাদি তো বারবার বিরোধী জোটের কথা বলেছেন।” কিন্তু বিজেপি তো বলছে বিরোধীদের সব নেতাই না কি চাইছেন তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন? “ওঁরা ঠিক বলছেন না। নির্বাচন আগে শেষ হোক। নেতৃত্বে ঠিক কেউ না কেউ চলে আসবেন। কে হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী– তখনই ঠিক হবে।”
সেটা কীভাবে হবে? “বিরোধীরা জিতুক। মমতার ঝান্ডা উড়বে। মায়াবতী-অখিলেশের ঝান্ডা উড়বে। রাহুল গান্ধীর ঝান্ডা উড়বে। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যখন জয়জয়কার হবে, তখন একসঙ্গে বসে মিলেমিশে ঠিক রাস্তাও বেরিয়ে আসবে।” বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করে চলে এলেন কংগ্রেসে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে বিজেপিতে ছিলেন। লালকৃষ্ণ আদবানির সঙ্গে আপনার গভীর সম্পর্কের কথা আপনি নিজেই বলেন, তাহলে এমন কী হল? এই প্রথম একটু থামলেন শত্রুঘ্ন। গাড়ির সামনের কাচ দিয়ে দূরের দিকে তাকালেন। গলাটা একটু নামিয়ে বলে উঠলেন, “কুছ তো মজবুরিয়া রহি, ভরনা ইঁউহি কোই বেবাফা নেহি হোতা। এটা তো এখন সবাই জেনে গিয়েছে শুধুমাত্র আমার সঙ্গে নয়, লালকৃষ্ণ আডবানীজি, বাজপেয়ীজি, মুরলী মনোহর যোশী, অরুণ শৌরি, যশোবন্তজিদের সঙ্গে ঠিক কী হয়েছে? এখন তো ওয়ান ম্যান শো, টু ম্যান আর্মি। অটলজির যাওয়ার পর লোকশাহি তানাশাহিতে বদলে গিয়েছে। তখন আমার মনে হল, ওঁরা তো এটা সহ্য করে গিয়েছেন। কিন্তু এটা ছেড়ে আমাকে আগে যেতে হবে অন্য জায়াগায়, কিন্তু সঠিক দিশায়।”
এবার তো তাহলে জনগণ আর ‘খামোশ’ থাকবে না? “আমি তো চাই জনতা এবার যেন খামোশ না থাকে। চাই সবাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুক। এই যে জোরজুলুমের পর এমন স্তুতিগান শোনানো হচ্ছে, এই যে এত টাকা খরচ করা হচ্ছে মিথ্যা প্রচারের জন্য, এই যে একটা প্রতিশ্রুতিও সরকার পালন করেনি, আমি বলি জনতার তো আওয়াজ তোলাটাই সঠিক কাজ হবে। কেন খামোশ থাকবে? কতদিন ধরে ওদের মিথ্যে কথা আর প্রচারতন্ত্রের শিকার হবেন তাঁরা?” আপনি ‘ওয়ান ম্যান শো, টু ম্যান আর্মি’-র কথা তুলছেন, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বারবার পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ নিয়ে এসে আক্রমণ করছেন? “পরিবারতন্ত্র! এই যে প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেন এই কথাটা, এটা কি কোনও ইস্যু? ওঁর কেউ না থাকতেই পারেন। কিন্তু যাঁদের পরিবারের কেউ ভোটে জিতে আসছে, তাঁদের কীভাবে আপনি পরিবারতন্ত্রের নাম দিচ্ছেন। পাঞ্জাব দেখুন, বিহার, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, কোথায় এমনটা নেই? এই পরিবারতন্ত্র-পরিবারতন্ত্র বলে উনি শুধু রাহুল গান্ধীর পরিবারকে লক্ষ্য করতে চাইছেন। কিন্তু এঁরা তো প্রতে্যকবার মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসছেন।”
তাহলে দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম আপনি এখনই বলতে চান না? “মানুষ ঠিক করবেন। মানুষের ভোটে নির্বাচিত সাংসদরা ঠিক করবেন, কে হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা কাদের রয়েছে– এই প্রশ্ন করেন, তাহলে আমি বলব, তালি যদি অধিনায়ক পায় তো গালিও অধিনায়কই পাবেন। গালি যদি অধিনায়ক পান তো তালিও তাঁরই প্রাপ্য। সেইদিক থেকে দেখলে সে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হন, অখিলেশ যাদব হন, মায়াবতী হন বা রাহুল গান্ধী হন– সবাই যথেষ্ট গুণী।” মমতাদির সাফল্য কামনা করলেন, উনি জিতলে আপনি তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে আসবেন? “আমি তো সবসময়ই যাই। ফের যাব। দেখুন, আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন বড় ভক্ত। সমর্থক তো বটেই। বন্ধু বলতে পারেন। ওঁকে সম্মান করি। ওঁর লড়াইয়ের, কাজের কদর করি। উনিও আমার কথা খুব মানেন। এটা আমার সৌভাগ্য।” এরপরই খানিকটা অবাক করেই পরিষ্কার বাংলায় দু’হাত তুলে বিহারীবাবু বলে উঠলেন, “আসি, নমস্কার। ভাল থাকবেন।”
ছবি: পিন্টু প্রধান
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.