সোমনাথ রায়, নয়াদিল্লি: দিল্লি থেকে হরিয়ানার মানেসরের আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পের দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। ৪৮ নম্বর জাতীয় সড়কের ঝিলমিল হোটেলের কাছের টোল প্লাজা থেকে পাঁচ কিলোমিটার এগোতে রাস্তার বাঁ-হাতেই সেই ক্যাম্প। এখানেই রাখা হয়েছে শনিবার ভোরে ইউহান (Wuhan) থেকে নিয়ে আসা অধিকাংশ ভারতীয় ছাত্রদের।
করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের মধ্যে চিনে আটকে পড়া দেশবাসীকে উদ্ধার করতে কেন্দ্রীয় সরকারের মরিয়া প্রয়াস সাধুবাদ কুড়িয়েছে তামাম দুনিয়ার। যেভাবে চিনের বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে ভারতীয়দের উদ্ধারের কাজ করেছে বিদেশমন্ত্রক, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
মানেসরের ক্যাম্পে পৌঁছতে পৌঁছতে শেষ হয়ে গিয়েছে নতুন দশকের প্রথম মাস। স্থানীয়দের মনে যাতে অহেতুক আতঙ্ক না ছড়ায়, তাই করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের যে এখানে রাখা হচ্ছে, অতি যত্ন সহকারে চেপে রাখা হয়েছে সেই খবর। ২-৩ কিলোমিটার আগে এনএসজি ক্যাম্প হোক বা এক কিলোমিটার আগের ন্যাশনাল ব্রেন রিসার্চ সেন্টার। কেউই জানেন না আক্রান্তদের ঠিকানার খবর।
শোনা গিয়েছিল যে, কেন্দ্র ক্যাম্পটি করেছে ভারতীয় সেনার যৌথ সহযোগিতায়। তাই আন্দাজ করেই পৌঁছে যাওয়া স্থানীয় আর্মি ক্যাম্পে। রাতে টহল দেওয়া একজনের নির্দেশ অনুযায়ী, জাতীয় সড়কের পাশের সার্ভিস রোড থেকে বাঁদিকে যাওয়া ‘কাচ্চি সড়ক’ ধরে কিছুটা এগোতেই রাস্তার দু’দিকে দু’টি সেনা ছাউনি। ডানদিকের দরজার বাইরে বড় করে লেখা ‘আর্মি ট্রেনিং সেন্টার’। উলটোদিকে ‘আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস’। মাঝে অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে দুই সেপাই। তাঁদের কাছে খোঁজ নিতেই বললেন, ‘হাঁ, করোনাওয়ালা ক্যাম্প ইয়েহি লাগা হ্যায়।’
পরিচয় দিতে ঠান্ডা মাথায় অনুরোধ, যা শোনাল নির্দেশের মতোই। বাংলা করলে যা দাঁড়ায়, তা হল, ‘এখানে কাউকে আসতে দেওয়ার অনুমতি নেই। বড় সাহেব বলে গিয়েছেন, কিছুতেই যেন মিডিয়াকে থাকতে দেওয়া না হয়। বিষয়টা বুঝুন। এই ভাইরাসে গোটা দুনিয়া কেঁপে গিয়েছে। প্লিজ চলে যান।’ অগত্যা রাস্তার উলটোদিকে অপেক্ষা। তবু লাভ হল না। বার তিনেক ঘুরে গেল হরিয়ানা পুলিশের টহলদারি ভ্যান। আড়াইটা নাগাদ এল আরও একটি জিপ। এবার সেনার। গলার সুর আর নরম নেই। এবার কড়া হুঁশিয়ারি। ‘হয় এখান থেকে চলে যান, না হলে নিরাপত্তার ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য অন্য কিছু করতে হবে।’ এরপর আর কিছু বলার বা করার থাকে না। কিছুটা বাধ্য হয়েই গাড়ি ঘোরাতে হল দিল্লির দিকে। পথে এল ‘ফৌজি দা ধাবা’। সেখানে চা খেতে খেতে এল পুলিশের আরেকটি গাড়ি। তাঁরা অবশ্য এসেছেন চা খেতেই। নিজেদের মধ্যে যেটুকু আলোচনা কানে এল, বোঝা গেল, চিন থেকে ভারতীয়দের আনার যে উদ্যোগ, যেভাবে নিয়েছে সরকার, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তাঁরাও।
এভাবে রাত শেষ হওয়ার পর ভোরে এল সুখবর। ইউহানে আটকে থাকা তিন শিশু-সহ ৩২৪ জন ভারতীয়কে দেশে ফিরিয়ে আনল এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৪৭ ডাবলডেকার বিমান। তবে শোনা গিয়েছে, ইউহান বিমানবন্দরে ছ’জন ভারতীয়কে ওই বিমান থেকে নামিয়ে দেয় চিন প্রশাসন। এক যাত্রী জানিয়েছেন, তাঁরা যখন বিমানে উঠতে যাচ্ছিলেন তখন তাঁদের প্রচণ্ড জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল। চেক-আপের সময় তা বুঝতে পেরেই বিমানযাত্রী, পাইলট ও বিমানকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কায় তাঁদের ভারতে আসার অনুমতি দেয়নি চিন প্রশাসন। অন্যদিকে শনিবারই আরও দুই ব্যক্তিকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে দিল্লির রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে ভরতি করানো হয়েছে। তাঁদের রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। দিল্লিতে মোট আটজন করোনা আক্রান্ত আশঙ্কায় ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে ফেরা ভারতীয়রা সকলেই সুস্থ আছেন বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে।
আরও জানা গিয়েছে, ইউহান প্রদেশ থেকে আসা যাত্রীদের মধ্যে ২১১ জনই পড়ুয়া। শনিবার রাতেই দিল্লি বিমানবন্দরে যাত্রীদের একপ্রস্থ পরীক্ষা করে এয়ারপোর্ট হেলথ অথরিটি ও আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল সার্ভিসেসের যৌথ দল। দেখা হয়, তাঁদের কারও করোনা আক্রান্তের লক্ষণ আছে কি না। এরপর ১০৩ জনকে ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশের বাসে পশ্চিম দিল্লির ছাওলা সেনা শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকিদের সেনার গাড়িতে আনা হয় মানেসরে। সেখানেই আপাতত আগামী দু’সপ্তাহ তাঁদের নজরে রাখবেন চিকিৎসকরা। সেনা শিবিরের ভিতরেই ছোটখাটো হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। কারও শরীরে সংক্রমণের লক্ষণ মিললেই তাঁকে দ্রুত আলাদা করে রেখে চিকিৎসা করা হবে। এছাড়া রবিবার দুপুরে এয়ার ইন্ডিয়ার আরও একটি বিমান চিনের হুবেই প্রদেশে গিয়ে বাকি ভারতীয়দের উদ্ধার করবে বলে খবর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.