বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত: এক-দুই-তিন কোটি নয়৷ একেবারে ৫৭০ কোটি টাকা!
তামিলনাড়ুতে বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে তিনটি কন্টেনার বোঝাই এই বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা আটক করল নির্বাচন কমিশন! এই বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় তীব্র চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে গোটা দেশে৷ এই টাকার উৎস ও তা কোথায় পাঠানো হচ্ছিল, খতিয়ে দেখছে কমিশন৷
এবার ভোটের আগে শুধুমাত্র তামিলনাড়ু থেকেই ১০০ কোটি কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করেছিল নির্বাচন কমিশন৷ গ্রেফতার হয়েছেন ৫২ জন৷ ধৃতদের অনেকেই আবার ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলের নেতা-কর্মী বলে পরিচিত৷ ভোট যত এগিয়ে আসছে, ততই রাজনৈতিক দলের তরফে টাকা ছড়ানোর চেষ্টা বাড়ছে৷ তাই নজরদারি আরও কড়া করেছিল নির্বাচন কমিশন৷ সেই নজরদারি চালাতে গিয়েই শনিবার সকালে তিরুপুর জেলায় ওই তিনটি ট্রাক আটক করা হয়৷ যদিও ট্রাকচালক ও সঙ্গীদের দাবি, ওই অর্থ একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের৷ অভ্যন্তরীণ লেনদেনের জন্য তা কোয়েম্বাটোর থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমের শাখায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল৷ কিন্তু তাঁদের কাছে প্রয়োজনীয় নথি পাওয়া যায়নি বলেই কমিশন সূত্রে খবর৷
প্যারামিলিটারি জওয়ান ও কমিশনের প্রতিনিধিরা থামতে বললেও ট্রাকগুলি গতি বাড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ তাদের ধাওয়া করে থামানো হয়৷ অনেকগুলি বাক্সে ভর্তি টাকা থাকায় ট্রাকগুলিকে আটক করে তিরুপুরের জেলা কালেক্টরের দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ট্রাকে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশকর্মী বলেও পরিচয় দিয়েছেন৷ পরে সন্ধ্যায় স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া জানায়, ওই অর্থ তাদেরই৷ অন্ধ্রপ্রদেশে অর্থের সাময়িক সংকট কাটাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশে ওই অর্থ পাঠানো হচ্ছিল৷ তাদের আরও দাবি, পুরো প্রক্রিয়াটি অনুমোদিত হলেও নির্বাচন কমিশন ভুল করে তা আটকে দিয়েছিল৷
বাংলায় গুড়-বাতাসা বা মুড়ি-ঘুগনি বিলি হচ্ছে শুনলেই রে রে করে ওঠে বিরোধীরা৷ চক্ষু চড়কগাছ হয় বঙ্গবাসীর৷ সাতদফার ভোটে এই নিয়ে কম হইচই হয়নি৷ বিষয়টি কমিশন পর্যন্ত গড়ায়৷ তাহলে তামিলনাড়ুর ঘটনা শুনলে কী বলবে বঙ্গবাসী৷
দক্ষিণ ভারতে ভোট ঘোষণামাত্রই রাস্তাজুড়ে প্রার্থী অথবা নেতানেত্রীদের আকাশ ঢাকা কাট আউট লাগানোটাই ছিল দস্তুর৷ সেই সঙ্গে দেওয়াল লিখন, বিশালাকার হোর্ডিং বা পোস্টার তো থাকতই৷ ভোটপ্রচারের মিছিল হত চোখে পড়ার মতো৷ মিছিলে কানফাটা বাজনার আওয়াজে নাভিশ্বাস উঠত৷ ভোটারদের মধ্যে নগদ টাকা ছড়ানোর অভিযোগও শোনা যেত৷ ভোটার স্লিপের সঙ্গে দু-পাঁচশো গুঁজে দেওয়া ছিল রেওয়াজ৷ এখন কমিশনের রক্তচক্ষুর ফলে এসব উধাও৷ গোটা তামিলনাড়ু চষে ফেললেও দু’দিন বাদে যে ভোট তা বোঝার উপায় নেই৷ নেই কাট আউট, হোর্ডিং বা পোস্টার৷ মিছিল হলেও তা যাতে ভোটারদের সমস্যা তৈরি না করে সেদিকে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাজনৈতিক দলগুলোর৷
নগদ বিলির রেওয়াজ পুরো বন্ধ করতে পারেনি কমিশন৷ বিপুল পরিমাণ টাকা ভোটারদের প্রভাবিত করতে রাজ্যের প্রধান দুই দল এআইডিএমকে ও ডিএমকে খরচ করছে বলে অভিযোগ তৃতীয় ফ্রণ্টের৷ শুক্রবারই তথ্যপ্রমাণ-সহ কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে তৃতীয় ফ্রণ্টের শরিক সিপিএম ও সিপিআই৷ সিপিএম সাংসদ টি কে রঙ্গরাজনের অভিযোগ, প্রচারে খরচ করতে না পেরে ভোটারদের কাছে নগদ টাকা পৌঁছনোর খেলায় মেতেছে রাজ্যের দুই প্রধান প্রতিপক্ষ৷ ভোটারদের মাথাপিছু এক হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে৷ পিছিয়ে পড়া এলাকায় এর পরিমাণ আরও বেশি৷ এমনকী তাঁদের দলের এক প্রাক্তন সাংসদের বাড়িতেও ভোটার স্লিপের সঙ্গে নগদ টাকা পৌঁছেছে বলে দাবি করেন তিনি৷ কোন দলের পক্ষ থেকে এটা করা হয়েছে তা অবশ্য জানাননি৷ একই অভিযোগ সিপিআই সাংসদ ডি রাজার৷ তিনি বলেন, “এই বিপুল পরিমাণ কালো টাকা উদ্ধারের ঘটনাই প্রমাণ করে ভোটে দেদার কালো টাকা উড়ছে৷”
এরই মধ্যে টাকা বিলির আগে মাদুরাই, ডিন্ডিগুল, বিরুধুনগর ও থেনি জেলায় শনিবার হাতেনাতে ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ৷ উদ্ধার হয়েছে ৫.১৭ লক্ষ টাকা৷ পাশাপাশি, নগদ টাকা নেওয়ার দায়ে প্রায় ২৫০ জন ভোটারকে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১৬০ নম্বর ধারায় সমন পাঠিয়েছে মাদুরাই জেলা প্রশাসন৷ তাঁদের ১৮ মে সশরীরে হাজিরা দিয়ে কারণ দর্শাতে হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার বৈজয়েন্দ্র এস বিদারি৷
তাঁদের বিরুদ্ধে তৃতায় ফ্রণ্টের অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে নারাজ এআইডিএমকে ও ডিএমকে৷ চেন্নাই শহরের এগমোড় কেন্দ্রের ডিএমকে প্রার্থী রবিচন্দ্রন বলেন “গোটা রাজ্যেই তৃতীয় ফ্রণ্টকে খুঁজে পাবেন না৷ ভোটের পর এরা সব অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে৷” তবে আম্মার দল দেদার নগদ টাকা বিলোচ্ছে বলে অভিযোগ করেন রবিচন্দ্রনও৷ পাল্টা তোপ দেগেছে এআইডিএমকে নেতৃত্বও৷ দলের মুখপাত্র মোহন এম কে অভিযোগ করেন, ভোটের আগেই হেরে বসে আছে দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম৷ তাই তৃতীয় ফ্রণ্টের নেতাদের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে৷ বরং তাঁদের পক্ষ থেকেই ডিএমকের বিরুদ্ধে কমিশনে নগদ ছড়ানোর অভিযোগ জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি৷
ভোটে ব্যাপক পরিমাণ কালো টাকা খরচের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক রাজেশ লাখনি৷ শুক্রবার সাংবাদিক সম্মেলনে ১০০ কোটি কালো টাকা উদ্ধারের হিসাব দিতে গিয়ে বলেন, “ভোট ঘোষণার পর থেকেই কালো টাকার দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল৷ এই টাকা ভোটারদের কাছেও যাচ্ছে বলে আমরা খবর পেয়েছি৷” তবে আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় এখন এই প্রবণতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে বলে দাবি তাঁর৷ নিয়ন্ত্রণের পরও উদ্ধার ১০০ কোটি! তার সঙ্গে শনিবার আটক হওয়া ৫৭০ কোটি টাকা ধরলে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়৷ এরপরও বেআইনি নগদ টাকা উদ্ধারের সম্ভাবনা আছে বলে আশঙ্কা কমিশনের৷ তাহলে আগে কত পরিমাণ খরচ হত তার কোনও খবরই কমিশনের কাছে থাকত না বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.