মণিশংকর চৌধুরি, গুয়াহাটি: অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকায় বাদ গিয়েছে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হিন্দু বাঙালিরাও। নাম বাদ যাওয়া অসমের বাসিন্দাদের ভবিতব্য কী? এনআরসি-র তালিকা প্রকাশের চব্বিশ ঘণ্টা পরে হতাশাই যেন সম্বল তাঁদের।
টাইম মেশিনে চড়ে একটা দিন আগে ফিরে যাওয়া যাক। শুক্রবার রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারেননি অসমের বাসিন্দারা। প্রহর গুনেছেন আর ভেবেছেন ‘বিদেশি’ হয়ে যাব না তো? পরিবারের সকলে একসঙ্গে থাকতে পারব তো? শনিবার সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত দমবন্ধ করা উদ্বেগ। অবশেষে সামনে এল সেই বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা। দোলাচলের পরেও স্বস্তি মিলল কই? এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় বাদ পড়েছে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম। কারও বাবার কপালে হয়তো শিকে ছিঁড়েছে। জুটেছে ‘দেশি’ তকমা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর ছেলে হয়ে গিয়েছেন ‘বিদেশি’।
জাতীয় নাগরিকপঞ্জির তালিকা প্রকাশের পর কেটেছে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা। তারই মাঝে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ যেন আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরেছে তাঁদের। চব্বিশ ঘণ্টার অনিশ্চয়তার জীবনই যেন তাঁদের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি আশ্বাস মিলেছে। এখনই হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই বলেই জানিয়ে দিয়েছে প্রশাসন। তবে তাতেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না কেউই। নাওয়া-খাওয়াও প্রায় ভুলে গিয়েছেন প্রত্যেকে। চোখের পাতা বুজলেই মনে হচ্ছে এই বুঝি প্রাণে বাঁচতে ‘পরদেশী’ হয়ে যেতে হবে তাঁদের। চলে যেতে হবে নিজের আত্মীয়-পরিজন এতদিনের চেনা পরিবেশ সবকিছু ছেড়ে। তালিকায় নাম না ওঠা অসমবাসীর বর্তমান পরিস্থিতি যেন শিকড় থেকে একটি সজীব গাছকে ছিঁড়ে ফেলার মতো।
জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ গিয়েছে প্রদীপ পাল নামে এক হিন্দু বাঙালির নাম। তিনি দীর্ঘদিনের অসমের বাসিন্দা। পানবাজারে একটি দোকানও রয়েছে তাঁর। স্ত্রী, সন্তান, বৃদ্ধা মা নিয়ে বেশ সুখের সংসার। এনআরসি তালিকায় নাম বাদ যাওয়ায় তাঁর দুশ্চিন্তা এবার বুঝি শান্তির নীড় ছেড়ে পাড়ি জমাতে হবে অন্য কোনও জায়গায়। কিন্তু কোথায় যাবেন প্রদীপ? নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকায় নাম কেন নেই, সেই কারণ জানার জন্য দৌড়োদৌড়ি করারও পরিস্থিতি নেই তাঁর। চূড়ান্ত হতাশ গলায় তিনি বলেন, “বাড়িতে বৃদ্ধা মা। তাঁর দেখভাল করতে হয় আমাকেই। তার উপর আবার দোকান রয়েছে। এত কিছু সামলে দিয়ে কীভাবে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে ছুটব।” শুধু প্রদীপই নন এরকম দমবন্ধ করা অবস্থা নাম বাদ যাওয়া ১৯ লক্ষ মানুষেরই।
এনআরসি নিয়ে রাজনৈতিক আকচাআকচি কম হয়নি। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, হিন্দু বাঙালিদেরকে হাতিয়ার করে ভোটবাক্সকে মজবুত করার ভাবনাই ছিল বিজেপির। কিন্তু সেই ভাবনাই সার। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর ওই ভাবনা যে অশ্বডিম্ব প্রসব ছাড়া আর কিছুই নয়, তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে গেরুয়া শিবির। এ প্রসঙ্গে ফোনে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইনকে শিলাদিত্য দেব জানান, “এনআরসি বড় ভুল। টার্গেট হয়ে গেলেন হিন্দু বাঙালিরাই।” বিরোধীদের গলার সুরও প্রায় একইরকম। কিন্তু রাজনৈতিক টানাপোড়েন নিয়ে সদ্য ‘বিদেশি’ তকমাপ্রাপ্তরা মাথা ঘামাতে নারাজ।
তবে চাপা ক্ষোভের মেঘে ক্রমশই মুখভার হচ্ছে অসমের আকাশের। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বড় কোনও অশান্তির খবর পাওয়া যায়নি। আগে থেকেই নিরাপত্তা আঁটসাঁট করা হয়েছিল। জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর নিরাপত্তা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে তালিকা থেকে বাদ পড়া কেউই অসম সংলগ্ন অন্য কোনও রাজ্যে অনুপ্রবেশ করতে না পারেন, সেদিকে বিশেষ নজর রেখেছে প্রশাসন। ইতিমধ্যেই নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ। একাধিক জায়গায় খোলা হয়েছে আউটপোস্ট। জায়গায় জায়গায় মোতায়েন রয়েছেন পুলিশকর্মীরা। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা গুয়াহাটি থেকে শিলং যাওয়ার রাস্তা। চলছে নাকা তল্লাশি। এদিকে, আবার এনআরসি-র পর আইএলপি বা ভারতীয় সরকার প্রদত্ত পরিচয়পত্রের দাবিতে সরব মণিপুরের বাসিন্দারা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.