নয়ের দশকের ‘মেলোডি কিং’ যদি কুমার শানু, উদিত নারায়ণ হন। তাহলে সেই সময়ের ‘মেলোডি ক্যুইন’ খেতাব অলকা ইয়াগনিকের (Alka Yagnik) প্রাপ্য। এমন শিল্পী আচমকাই শোনার শক্তি হারিয়েছেন। কারণ সেন্সরি নিউরাল হিয়ারিং লস। কেন হয় এই সমস্যা? শ্রবণক্ষমতা কীভাবে ফিরে পাবেন? বিশদে জানাচ্ছেন এইচপি ঘোষ হাসপাতালের ইএনটি সার্জন ডা. অশোক সাহা। লিখেছেন পৌষালী দে কুণ্ডু।
“কয়েক সপ্তাহ আগে বিমান থেকে নামার পরেই হঠাৎ আমার মনে হল আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না। আমার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন আমি এক বিরলতম ‘সেন্সরি নিউরাল হিয়ারিং লস’ নামের অসুখে আক্রান্ত হয়েছি। ভাইরাল অ্যাটাকের কারণেই এমন হয়েছে। আমার জন্য প্রার্থনা করুন সবাই।” বক্তা বলিউডের মেলোডি কুইন অলকা ইয়াগনিক।
বেসরকারি অফিসে কর্মরত সৌরভ চক্রবর্তী সারাদিন কানে হেডফোন গুঁজে থাকেন। কখনও ক্লায়েন্টের সঙ্গে ফোনে কথা, কখনও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা কখনও আবার গান শোনেন। দুম করে একটা কানে শুনতে পাচ্ছিলেন না! তাড়াতাড়ি ট্রিটমেন্ট করায় ফের ফিরে পেয়েছেন শ্রবণশক্তি।
কী ভয়ানক ব্যাপার ভাবুন তো! দিব্যি সুস্থ গায়িকা হঠাৎই তাঁর শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন। অতিরিক্ত হেডফোন ব্যবহার করা চাকরিজীবীরও আচমকা হিয়ারিং লস! কী এই সমস্যা সেন্সরি নিউরাল হিয়ারিং লস? যে কেউ যখন তখন আক্রান্ত হতে পারেন
না কি!
সেন্সরি নিউরাল হিয়ারিং লস
অন্তঃকর্ণে কোনও সমস্যা হলে শ্রবণক্ষমতা কমে যায়। তখন তাকে বলে সেন্সরি নিউরাল হিয়ারিং লস। অভ্যন্তরীণ কানের সংবেদনশীল কোষ বা মস্তিষ্কে শ্রবণ সংক্রান্ত নার্ভের পথে কোনও সমস্যা থাকলেও সেন্সরি নিউরাল হিয়ারিং লস হয়। অর্থাৎ ককলিয়ার বা ককলিয়ার থেকে ব্রেনের মধ্যে সংযোগকারী নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মস্তিকে শব্দের সিগন্যাল পৌঁছয় না। ফলে শোনার শক্তি থাকে না।
কেন হয়?
এ দেশে শব্দদূষণের কারণে এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি হয়। লাউড সাউন্ড, উচ্চস্বরে গান শোনা, ট্র্যাফিক, গাড়ির হর্ন ইত্যাদি যান্ত্রিক শব্দের গভীরতা খুব তীব্র হলে ও এবং এমন পরিবেশের মধ্যে থাকলে সেন্সরি নিউরাল হিয়ারিং লস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৮৫ ডেসিবলের উপরের কোনও শব্দ অন্তঃকর্ণে ধাক্কা খেলে অন্তঃকর্ণের শ্রবণশক্তি লোপ পায়।
কোনও কারণে অটোইমিউন ডিজঅর্ডার হলেও হঠাৎ করে কানে শুনতে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে হয়তো দেখা গেল, ককলিয়ার নার্ভে রক্ত চলাচলের পথ ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে।
কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, ল্যাসিক, কিছু অ্যান্টি ক্যানসার ওষুধ আছে, যেগুলি শ্রবণক্ষমতা নষ্ট করতে পারে।
ধরা যাক, হঠাৎ তিন দিনের মধ্যে কেউ ৩০ ডেসিবলের বেশি হিয়ারিং লস হয়েছে তখন তাকে সাডেন সেন্সরি নিউরাল হিয়ারিং লস বলে। এক্ষেত্রে সাধারণত একটা কানের শ্রবণক্ষমতা
লোপ পায়।
জেনে রাখা দরকার, বয়সজনিত কারণে শোনার সমস্যা দু’কানে বেশি হয়। এক্ষেত্রে একটু একটু করে শ্রবণ ক্ষমতা কমতে থাকে।
ককলিয়ার থেকে ব্রেনের মধ্যে লিঙ্ক করা নার্ভে যে রক্ত চলাচল করে, তার পথ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে ভাস্কুলার হিয়ারিং লস হয়। এটাও আচমকা হতে পারে।
ভাইরাল অ্যাটাকও কারণ
মাম্পস, মিজলস, রুবেলা ভাইরাস, হারপিস সিম্পেলক্স ভাইরাস সরাসরি হিয়ারিং লসের সঙ্গে জড়িত। প্রেগন্যান্সিতে এই ভ্যাকসিন দেওয়া থাকলে গর্ভস্থ শিশুর রুবেলা ইনফেকশন হবে না। তার শ্রবণ সমস্যার ঝুঁকিও অনেক কমে যাবে। সিফিলিসও সেন্সরি নিউরাল হিয়ারিং লসের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। সাইটোমেগালোভাইরাসও শ্রবণক্ষমতা লোপের অন্যতম কারণ হতে পারে। ম্যানিনজাইটিস ব্যাকটিরিয়াল ইনফেকশনও কারণ হতে পারে। সর্দি-জ্বরে ভোগার পর হঠাৎ কানে শুনতে না পেলে বুঝতে হবে ভাইরাল ইনফেকশনের কারণেই এমন হয়েছে।
শনাক্তকরণে কোন টেস্ট?
সাধারণ শ্রবণক্ষমতার মানুষ শব্দের মাত্রা ২৫ ডেসিবলের মধ্যে থাকলে শুনতে পায়।
শব্দের মাত্রা ২৫-৪০ ডেসিবলের মধ্যে থাকলে তাকে বলে অল্প হিয়ারিং লস।
৪০-৫৫ ডেসিবলের মধ্যে হিয়ারিং লসকে বলে মডারেট লস। হিয়ারিং লসের মাত্রা ৫৫-৭১ ডেসিবলের উপরে থাকলে তাকে বলে সিভিয়ার হিয়ারিং লস।
অডিওমেট্রি টেস্ট করে বোঝা যায় হঠাৎ করে শ্রবণক্ষমতা কতটা লোপ পেল।
এছাড়া ক্লিনিক্যালি টিউনিং ফর্ক টেস্ট করা হয়। ভাইব্রেটিং টিউনিং ফর্কটি (৫১২ হার্জ) কপালের মধ্যভাগে স্পর্শ করার পর বোঝা যায় রোগীর সেন্সরি নিউরাল
হিয়ারিং লস হয়েছে নাকি কন্ডাক্টিভ হিয়ারিং লস হয়েছে? একে ওয়েবার’স টেস্টও বলা হয়। যদি সেন্সরির নিউরালের সমস্যা হয় তা হলে ওয়েবার’স টেস্টের সাউন্ড ভাইব্রেশন ভালো কানের দিকে শিফট হবে।
রিনি টেস্ট করেও সমস্যা শনাক্ত করা যায়। কানের লতির পিছনের দিকে ম্যাসটয়েড বোনের উপর টিউনিং ফর্কটি রেখে রোগীকে কোনও শব্দ শোনানো হয়। তারপর ফর্কটি সামনে এনে আবার শব্দ শোনানো হয়।
যদি দেখা যায়, সামনে আনলে শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু কানের পিছনে রাখলে কম শুনছে তা হলে বুঝতে হবে, রোগীর শ্রবণশক্তি স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু ঠিক এর উল্টো হলে অর্থাৎ ফর্কটি পিছনে রাখলে শুনতে পেলে ও সামনে আনার পর কম শুনলে বুঝতে হবে কন্ডাকটিভ হিয়ারিং লসের সমস্যা আছে।
এবিসি টেস্টও গুরুত্বপূর্ণ।
এমআরআই করেও সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় কানের কোন শিরায় সমস্যা হচ্ছে।
লাউড মিউজিক, হেডফোনে বিপদ
খুব জোরে মিউজিক চালালে বা হেডফোনের সাউন্ড বেশি রাখলে এই সমস্যা বাড়ে। তীব্র আওয়াজ অন্তঃকর্ণে যে শ্রবণ কোষ (হিয়ার সেল) থাকে, তাকে দুর্বল করে দেয়। মোবাইল ফোনের হেডফোন ব্যবহার করে কথা বলতে হলে টানা ৩০ সেকেন্ডের বেশি কখনওই কথা বলা উচিত নয়। জোরে গান শুনবেন না। যানজট, ট্র্যাফিক এলাকায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে না থাকার চেষ্টা করবেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.