ফোন, ল্যাপটপের ঘেরাটোপে এখন শিরদাঁড়া সোজা রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। অযাচিতভাবে চাপ, বেকায়দায় ওঠা-বসা, ঠায় বসে কাজ, সবেতেই কিন্তু বিকল হতে পারে মেরুদণ্ড। নিত্য ব্যস্ততার মাঝেও এই বিশেষ হাড়টির যত্ন নেওয়া কেন দরকার। বিস্তারিত জানালেন নিউরোসার্জন ডা. সুস্মিত নস্কর।
শিরদাঁড়া আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যা একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়। বিশেষত বর্তমান প্রজন্মের কাছে শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলাটাই বিশাল ব্যাপার। সারাক্ষণ ফোনে, না হলে ল্যাপটপে আমরা বন্দি। ফলে সরাসরি মেরুদণ্ডে চাপ পড়ে বিশাল পরিমাণে। প্রাথমিক অবস্থায় তা তেমন সমস্যা করে না। তবে ধীরে ধীরে জটিলতা বাড়ে। তখন হয়তো অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।
যেভাবে চাপ পড়ে
চারভাগে বিভক্ত আমাদের মেরুদণ্ড। ঘাড় বা সার্ভাইক্যাল স্পাইন, পিঠ বা থোরাসিক স্পাইন, কোমর বা লাম্বার স্পাইন ও স্যাকরাম বা টেল বোনের অংশ যার উপর ভর দিয়ে একজন বসেন। এই নিয়ে গোটা একটা শিরদাঁড়া।
যার ঘাড় ও কোমরের অংশে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে। কারণ, এই অংশে সারাদিনের হাঁটাচলা কিংবা বেকায়দায় ওঠাবসা, ফোনে-ল্যাপটপে মুখ গুঁজে কাজ সবক্ষেত্রেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রেশার পড়ে। ফলে ক্ষয়ও হয় বেশি। ধীরে ধীরে কোমরের নানা ডিস্কগুলো খারাপ হতে থাকে, দুর্বল হয়ে যায়। তখনই ব্যথার শুরু হয়।
কখন বুঝবেন গন্ডগোলের ব্যথা
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর উঠলে কোমরে বা ঘাড়ে ব্যথা শুরু হবে, পিঠের অংশ আড়ষ্ট হয়ে থাকে। যদি দেখেন ব্যথা ঘাড় থেকে হাতে ও কোমর থেকে পায়ের দিকে নামছে তখন কিন্তু সেটা হালকা করে নেবেন না। কারণ এক্ষেত্রে শিরদাঁড়ার ডিস্ক অকেজো হতে শুরু করে। অতিরিক্ত চাপ পড়ার ফলে শিরদাঁড়ার ডিস্ক ফেটে বেরিয়ে আসে ও নার্ভে চাপ ফেলে, যা থেকে ব্যথা ছড়ায়। এই অবস্থাকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয় স্লিপ ডিস্ক। প্রাথমিক অবস্থায় ব্যথা অবহেলা করলে স্লিপ ডিস্কের প্রবণতা বাড়ে।
বুঝে চলুন, বসুন
শুধু নির্দিষ্ট স্থানে ব্যথা হলে এক্সারসাইজ, বসার ধরন বদলানো, লাইফস্টাইল পরিবর্তন বা ওজন কমানো দরকার, ধূমপান বর্জন করা প্রয়োজন। তাহলেই ধীরে ধীরে ব্যথা কমবে। দেখা গিয়েছে ধূমপান করার ফলে শিরদাঁড়ার ডিস্কের মধ্যে জেল জাতীয় যে উপাদান থাকে তা ড্রাই হতে থাকে। ফলে সমস্যা বাড়ে।
ঘাড়ে বা কোমরে ব্যথা শুরু হলে সেটাকে বলে স্পন্ডিলোসিস। এক্ষেত্রে সঠিক ভঙ্গিমায় বসতে হবে, বসার চেয়ার প্রয়োজনে পালটাতে হবে, সারাক্ষণ ফোন দেখার অভ্যাস বদলাতে হবে। পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন।
টানা বসে কাজ করার ক্ষেত্রে আর্গোনমিক চেয়ারের ব্যবহার দরকার। এটা শিরদাঁড়াকে সম্পূর্ণ সাপোর্ট দেয়, চাপ পড়ে না।
টানা বসে কাজ হলেও এক ঘণ্টা অন্তর উঠে দাঁড়ান। ঘাড় ও কোমর সোজা করুন, একটু হাঁটাচলা করে তারপর আবার বসুন।
ল্যাপটপে বা ডেস্কটপে কাজ করলে তা চোখের সরলরেখা অনুযায়ী সোজাসুজি না রেখে একটু উপরে রেখে কাজ করা উচিত।
ঘুম থেকে ওঠা ও ঘুমাতে যাওয়ার আধ ঘণ্টা আগে মোবাইল ধরবেন না। ফোন দেখলে ঘাড় সোজা করে দেখবেন।
ব্যথা ধরতে কী দরকার?
এক্সরে বা এমআরআই করার দরকার হয়। প্রয়োজনে সিটিস্ক্যান করা যেতে পারে।
অল্প ব্যথা হলে নিজে থেকে ব্যথার মলম লাগান, অল্প রেস্ট নিন, লাইফস্টাইল পরিবর্তন করুন, ভালো থাকবেন।
কিন্তু ব্যথা যদি ৬ সপ্তাহের বেশি থাকে তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সাধারণত ২৮ বছর বয়সের পর থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে এমন সমস্যা বেশি হয়। তবে বর্তমানে স্কুল পড়ুয়াদেরও সমস্যা বেড়েছে। কারণ ওবেসিটি এক্ষেত্রে একটি মেজর রিস্ক ফ্যাক্টর।
কখনও অপারেশনও লাগে
স্লিপ ডিস্ক হলে রেস্ট বা বিশ্রাম দরকার। সঙ্গে ওষুধ খেতে হবে। তবে ব্যথার সঙ্গে নিউরোলজিক্যাল সমস্যা থাকলে তখন কিন্তু আরও গভীরে গিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। নির্দিষ্ট নার্ভে বেশি চাপ পড়ে দুর্বল হয়ে গেলে মাইক্রোসার্জারির দরকার পড়ে।
২০ বছর বয়সের নিচে স্লিপ ডিস্ক হলে অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা বেশি।
সবশেষে একটা কথাই বলব, এই ধরনের ব্যথা নিয়ে অবহেলা করবেন না। যেটা অধিকাংশই করে থাকেন। আমরা এমন রোগী রোজই পাই, হয়তো প্রথমেই সতর্ক হলে ব্যথা সেরে যেত। কিন্তু ব্যথা শিরদাঁড়ার উপর আরও চাপ ফেলার ফলে তার পরিণতি সারাজীবন কষ্ট বয়ে বেড়ানো।
ফোন – ৮৬৯৭২০০৬৭০
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.