সাধারণ খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম থেকেই হতে পারে গুরুতর অসুখ। চেনা লক্ষণ দেখে গুরুত্ব দেয় ক’জন! পাকস্থলীর ক্যানসারের প্রকাশ কিন্তু স্বাভাবিক সমস্যা দিয়েই। কখন সাবধান হবেন বুঝিয়ে বললেন সরোজ গুপ্ত ক্যানসার হাসপাতালের অঙ্কোলজিস্ট ডা. অর্ণব গুপ্ত।
কিছুমাস ধরেই অল্পস্বল্প পেটে ব্যথা বছর ৫৪-র আদৃতবাবুর। খেতেও মন লাগছিল না তাঁর। এরকম তো টুকটাক হয়েই থাকে, এই ভেবে এড়িয়ে গিয়েছেন ব্যাপারটাকে। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাত্রি থেকে কালচে রক্তযুক্ত মল ও কিছুটা পেট ফুলতে শুরু করে। নজরে আসতেই, ভয় পেয়ে যান পরিবারের লোকজন। পেটে ব্যথা করছে, খিদে নেই, ক’দিন ধরেই বমি বমি ভাব! অনেকেই ভাবেন হয়তো খাওয়া দাওয়ার বেনিয়মে এমনটা হচ্ছে। এ তো খুবই সাধারণ ঘটনা। টানা এমন হতে থাকলে তা পিছনে থাকতে পারে বেয়াড়া পাকস্থলী ক্যানসার (Stomach Cancer)।
সমীক্ষার তথ্য, এই ক্যানসারের স্থান সারা বিশ্বের নিরিখে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। মধ্যবয়স্ক অর্থাৎ ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সি পুরুষেরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন। ২০০১ সালে প্রতি বছর এদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৩৫ হাজার, যা সম্প্রতি অবহেলার কারণে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ হাজারে।
রোগের পূর্বাভাস দেখা দেয়
প্রাথমিক পর্যায়ে তিনটি – এ (A) অর্থাৎ অ্যানিমিয়া (শরীরে রক্তশূন্যতা), অ্যানোরেক্সিয়া অর্থাৎ খিদে কমে যাওয়া, অ্যাস্থেনিয়া বা ওজন কমে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়। এছাড়াও পেটে ব্যথা, মেলিনা (মলের সঙ্গে কালো রক্ত), পেট ফুলে যাওয়া, খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়া, মাথা ঘোরা ইত্যাদিও প্রথম দিকে লক্ষণীয়।
কী খাচ্ছেন, তার সঙ্গে নিবিড় যোগ
মূলত খাদ্য অভ্যাসের অনেকাংশেই নির্ভর করে পাকস্থলীর ক্যানসার হবে কি না সেই বিষয়টি। অনিয়ন্ত্রিত লাইফ স্টাইল যেমন- ক্রমাগত তামাক দ্রব্য সেবন, নোনতা খাবার খাওয়া, প্রিজারভড ফুড, রেডমিট অর্থাৎ গরু, পাঁঠা, শুয়োরের মাংস, বার্নড ফুড (কাবাব, তন্দুরি, বার্বিকিউ- এতে থাকা কার্বন আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর) পাকস্থলী ক্যানসারের মূল কারণ। যে কোনও খাবার থেকে অনেকের ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে ঘনঘন পেটে ব্যথা হলে এইচ পাইলরি (হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি) ভাইরাসের ফলে এই ক্যানসারের প্রবণতা বাড়ে।
খালি পেটে থাকা খুব খারাপ
ডায়েট করতে গিয়ে অনেকেই ভাবেন একটা সময় খাবার স্কিপ করাই যায়। নিজে থেকে ডাক্তারি করতে গিয়েই বিপদ ডেকে আনেন। আসলে, যখন খিদে পায় বা যখন আমরা খাবার খাই তখন পাকস্থলী থেকে এইচসিএল অর্থাৎ হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড নির্গত হয়। যা আমাদের হজমে সাহায্য করে। খালি পেটে থাকলে এবং অভ্যাস দিনের পর দিন চললে এই অ্যাসিড নির্গত হতে পারে না। ফলে, পাকস্থলী ক্ষয় হয়ে গ্যাস্ট্রিক আলসারের রূপ ধারণ করে। পরবর্তীকালে এটিই পাকস্থলীতে ক্যানসারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই খালি পেটে দীর্ঘক্ষণ থাকা মোটেই ভালো নয়।
খাদ্যাভ্যাস ছাড়া আর কী কী দায়ী?
ওবেসিটি অর্থাৎ ওজন বেশি হলে পাকস্থলীর ওপরের দিকে ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা
দেখা যায়। পাকস্থলী এবং খাদ্যনালির যে জংশনটা রয়েছে সেটা অ্যাসিডের কারণে পুড়ে গিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। পারিবারিক ইতিহাসের গুরুত্বও রয়েছে এখানে। বংশসূত্রে পরিবারের পর পর প্রজন্মের এই ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
উপযুক্ত ডায়েট দরকার
অবশ্যই। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে খাওয়া-দাওয়া করলে শুধুমাত্র এই রোগ কেন, যে কোনো রোগের হাত থেকেই মুক্তি পাওয়া যায়। এখানে একটা জিনিস উল্লেখ করি, অনেকে যাঁরা বেশি নুন খান তাঁরাও কিন্তু নিরাপদ নন। যত হেলদি খাবার খাবেন ততই এই রোগের সম্ভাবনা কমবে। ডায়েটের মধ্যে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত রাখুন সাইট্রাস জাতীয় ফল যেমন- পাতিলেবু, কমলালেবু, মৌসম্বি, এছাড়াও শাকসবজি, চিকেন, মাছ, গ্রিন টি, বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যুক্ত খাবার, পিঁয়াজ, রসুন, ভিটামিন সি জাতীয় খাবার। সারাদিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খান।
প্রতিহত করতে
আমি আগেই বলব, পরিবারগত ইতিহাস থাকলে অবশ্যই ৩০ বছর বয়সের মধ্যে জিন টেস্ট করিয়ে নিন। যদি জিনের মধ্যে কোনওরকম ত্রুটি থেকেও থাকে, তাহলে সেটাকে সর্বপ্রথম নির্মূল করুন। যত দেরি করবেন ততই ঝুঁকি বাড়বে।
ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। প্রথম পর্যায়ে ধরা পড়লে শুধুমাত্র অপারেশনের মাধ্যমেই এই ক্যানসার পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব। স্টেজ যত অ্যাডভান্সড হবে ততই কমতে থাকবে আয়ু। অ্যাডভান্সড স্টেজে চলে গেলে রোগীরা মাত্র ৬ মাস থেকে ১ বছর অবধি বেঁচে থাকতে পারেন।
যাঁদের ওবেসিটি বা মেদবহুল চেহারা, তাঁরা নিজের খাওয়া-দাওয়া কন্ট্রোল করুন, যদি বুকে ব্যথার প্রবণতা থাকে তাহলে অ্যান্টাসিড জাতীয় ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাবেন না। এছাড়াও কম তেল, মশলাযুক্ত খাবার, অ্যালকোহল, ধূমপান বন্ধ করুন।
জীবন একটাই, সুস্থ ভাবে বাঁচুন, টাকা জমান ঘুরতে যান, পুরোপুরি উপভোগ করুন। নাই-ই বা খেলেন ছাইপাঁশ। ভেবে দেখুন তো খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে আপনার? স্বল্প নিয়ন্ত্রণ হলেই মিলবে অনেক উপকার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.