ঘাড়-কাঁধের যন্ত্রণা কমাতে সেলুনে একটু ম্যাসাজ করিয়ে নেন? পার্লারে শ্যাম্পু করিয়ে অভ্যস্ত? সেকেন্ডের মধ্যে হতে পারে স্ট্রোক। সতর্ক করছেন ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সের নিউরোরিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের প্রধান ডা. সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায়। লিখলেন পৌষালী দে কুণ্ডু।
‘কী রে, কেমন আছিস?’ বন্ধুদের আড্ডায় বাপ্পাকে অনেকদিন পর দেখতে পেয়ে কাঁধে জোরসে একটা চাপড় দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল সৌগত। উত্তর দেওয়ার আগেই ঘাড় এলিয়ে গিয়েছিল ২২ বছরের তরতাজা ছেলেটির। ডাক্তার বলেন, ‘স্ট্রোক!’ দিন দশেক আইটিউতে থেকে প্রাণে বাঁচলেও হাঁটতে-চলতে পারছে না। এখন জোরকদমে চলছে নানা থেরাপি।
দ্বিতীয় ঘটনা, রবীনদার সেলুনে। আর পাঁচটা কাস্টমারের মতোই চুল-দাড়ি কাটার পর রবীনদাকে ঘাড়-হাত-পা ম্যাসাজ করে দিতে বলেছিলেন মুখোপাধ্যায় মশাই। প্রায় সবাইকেই ঘাড় মটকে, কিল-ঘুসি মেরে, তেল মাখিয়ে হাত-পিঠ-কাঁধে ম্যাসাজ করে দেয় পাড়ার সকলের প্রিয় নাপিত। সেদিনও ম্যাসাজের সময় আরামে চোখ বুজে আসছিল মুখোপাধ্যায়বাবুর। কিন্তু কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎই খিঁচুনি শুরু হল। তারপর সঙ্গে সঙ্গে সেলুনের চেয়ারে বসে ঢলে পড়লেন। তাঁরও নাকি ম্যাসিভ স্ট্রোক।
ঝাঁচকচকে স্পা, পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা ম্যাসাজ পার্লার, সেলুনে গা-হাত-ঘাড় টেপাতে গিয়ে এমন বিপদ কখন যে কার জীবনে আসবে কেউ জানেন না। যে কারও সঙ্গেই হতে পারে। কেন এমন হয়? ডাক্তারি ভাষায় মূলত এই ধরনের কেসে ভার্টিব্রাল আর্টারি ডিসেকশনের কারণে স্ট্রোক হয়। ঘাড়ের দু’ধারে থাকা মোটা দুটো রক্তবাহী ধমনী হল ভার্টিব্রাল আর্টারি। আচমকা সেখানে কোনও জোর ধাক্কা লাগলে ধমনীর ভিতরের অংশ ছিঁড়ে যেতে পারে বা প্রায়ই আঘাতপ্রাপ্ত হতে হতে ধমনীর পথ সরু বা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যার ফলে রক্ত জমাট বেঁধে বা রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্রেনে রক্ত পৌঁছতে না পারায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রেন হেমারেজ শুরু হয়ে যায়।
আকস্মিক এমন পরিস্থিতি ছাড়াও কানেকটিভ টিস্যু ডিজঅর্ডারের (নন-ট্রমাটিক) কারণে ব্যক্তির এই ধমনীর ভিতরের অংশ সোজা না থেকে কাঁপা কাঁপা বা দুর্বল হতে পারে। তাদেরও আঘাত লেগে এই বিপদ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। অনেক সময় ধমনির ভিতরের পাতলা আস্তরণ ছিঁড়ে ব্রেনের যে সব অংশে রক্ত পৌঁছনোর কথা নয়, যেখানে ফ্লুইড থাকে সেখানেও রক্ত গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বছর কয়েক আগে সিডনির মাঠে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ফিলিপ হুজের ঘাড়ে বল লাগার ঘটনা নিশ্চয় মনে আছে! হেলমেটের নিচ দিয়ে ঘাড়ে বল লেগে ক্রিজেই মৃত্যু হয় তাঁর। সেই মর্মান্তিক মৃত্যুর কারণও ছিল ভার্টিব্রাল আর্টারি ডিসেকশনের কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ।
কারা করবেন ম্যাসাজ?
মনে রাখবেন সেলুন, স্পা-পার্লার-বাড়িতে ম্যাসাজ করতে আসা অপেশাদারদের দিয়ে কখনওই কাঁধ-ঘাড়, পিঠের উপরের অংশ ও মাথায় ম্যাসাজ করাবেন না। শরীরের কোন অংশে কতবার, কতটা চাপ দেওয়া উচিত, কতটা স্পিডে করা উচিত, কোন শিরায় কতটা জোর দিলে শিয়রে মৃত্যু এসে দাঁড়াতে পারে তা নাপিত-হেয়ার স্টাইলিস্টরা জানেন না। হয়তো সেই নাপিত ঘাড়-কাঁধের ব্যথা কমানোর ম্যাসাজের মোটামুটি টেকনিক রপ্ত করেছেন।
কিন্তু সমস্যা সব সময় কেউ কতটা জানে, তা দিয়ে হয় না। কতটা জানে না, তা থেকে হয়। তাই ব্যথা-যন্ত্রণা হলে প্রথমেই নিউরো রিহ্যাবলিটেশন বিশেষজ্ঞর কাছে যান। তিনি সমস্যা বুঝে নিউরো-ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে পাঠাতে পারেন। অ্যানাটমি, ফিজিওথেরাপি, প্যাথোলজি নিয়ে সঠিক জ্ঞান ও ডিগ্রি আছে এমন ব্যক্তি সঠিকভাবে এইসব যন্ত্রণার উপশম করতে পারেন। পড়াশোনা করা, পেশাদার ম্যাসিওর, কায়রোপ্র্যাক্টর কিছুটা তবু জানেন।
বিপদ বুঝবেন কীভাবে?
ভুলভাল পদ্ধতিতে ম্যাসাজ করানোর জন্য ভার্টিব্রাল আর্টারি ডিসেকশন একটু একটু করে শুরু হতেও পারে। সেক্ষেত্রে লক্ষণ হিসাবে যেদিকের ভার্টিব্রাল ধমনীর ভিতরে সমস্যা তৈরি হয় সেদিকের মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। দু’দিকের শিরায় সমস্যা হলে গোটা মাথাজুড়েই অসহনীয় যন্ত্রণা হবে। ব্যথা নিচ থেকে মাথার মাঝের দিকে উঠতে থাকবে। মাইগ্রেন ভেবে অবহেলা করবেন না। এটা শনাক্ত করতে সিটি অ্যাঞ্জিওগ্রাম করতে হবে। ফেলে রাখলে পরিস্থিতি হবে আরও জটিল। এছাড়া ব্যালেন্সের সমস্যা হয়, হাঁটাচলায় অসুবিধা হবে। কথা বলতে, দেখতে অসুবিধা হবে। কখনও কখনও একটা চোখ নেমে যায়।
সেলুনে সতর্ক
নামীদামি বা পাড়ার সেলুনে গিয়ে ঘাড়-কাঁধ-মাথায় ম্যাসাজ করাবেন না।
সেলুনে শ্যাম্পু করতে গিয়েও ভার্টিব্রাল আর্টারি ডিসেকশন হতে পারে। চুল ধোয়ানোর সময় সিঙ্কে ঘাড়ের চাপ লাগে। তখন বিপদ ঘটতে পারে। একে বলে ‘বিউটি পার্লার স্ট্রোক সিন্ড্রোম’।
চুল ধোয়ার সময় খেয়াল রাখুন আপনার ঘাড় কমফর্টেবল পজিশনে রাখা আছে কি না। ঘাড় পিছন দিকে ২০ ডিগ্রির বেশি ঝোঁকানো উচিত নয়। ঝুঁকি কমাতে অ্যাডিশনাল নেক সাপোর্ট চেয়ে নিন।
অতিরিক্ত হাই প্রেশার বা স্ট্রোক হওয়ার অন্যান্য ঝুঁকি থাকলে আগে থেকে সেলুনে জানিয়ে রাখুন। সেক্ষেত্রে শ্যাম্পুর সময় মাথা উপর বা পিছনের দিকে না ঝুঁকিয়ে রেখে সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখুন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.