সুনীল ছেত্রী ও তাঁর বাবা খড়্গ ছেত্রী।
কৃশানু মজুমদার: এই শহর জানে তাঁর প্রথম সবকিছু! সুনীল আবেগে ভাসছে কলকাতা।
একদিন ফুটবল পরিক্রমা শুরু হয়েছিল তিলোত্তমা থেকে। শেষটাও হচ্ছে সেখানেই। শুরু আর শেষ মিশে যাচ্ছে একই বিন্দুতে।
একটা সোনালী বৃত্ত সম্পূর্ণ করছেন সুনীল ছেত্রী। ভক্ত-অনুরাগীরা গাইছেন, ”এখনই শেষের গান গেয়ো না।”
যাঁর জন্য হৃদয়ের একুলওকুল ভাঙছে, সেই সুনীল কিন্তু জানিয়ে দিয়েছেন, কুয়েত ম্যাচই তাঁর শেষ স্টেশন। সিদ্ধান্ত আর বদলাবেন না।
লক্ষ্মীবারের যুবভারতীতে ‘দ্য লাস্ট ড্যান্স’। টিকিটের চাহিদা তুঙ্গে।’শেষের জলসা’য় একটা আসনও ফাঁকা থাকবে না। ভক্ত-অনুরাগীদের মতো সুনীলও কি আবেগে ভাসবেন না?
ভাসবেন তো নিশ্চয়ই। বাবা, মা, বোন, বন্ধু, হাজার হাজার সমর্থকের সামনে শেষ ম্যাচ খেলতে নামলে তো আবেগপ্রবণ হয়ে যাওয়ারই কথা। ছেলের শেষ ম্যাচ দেখতে কলকাতায় এসে পড়েছেন বাবা খড়্গ ছেত্রী, মা সুশীলা এবং বোন।
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে সুনীলের বাবা বললেন, ”মনে হচ্ছে কাল থেকেই সব নতুন করে শুরু করছে।”
খড়্গ ছেত্রীর চোখে ভাসছে অসংখ্য স্মৃতি। সেগুলো দিয়েই মালা গাঁথছেন তিনি। দেশের অসংখ্য সমর্থক-অনুরাগীদের মতো তিনিও কি বলছেন না, ‘শো মাস্ট গো অন’! খড়্গের চটজলদি জবাব, ”হিন্দিতে একটা কথা প্রচলিত আছে, ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর।আমার মনের অবস্থাও এখন তাই।”
প্রথমবার দেশের জার্সি হাতে নিয়ে তাতে পারফিউম লাগিয়েছিলেন সুনীল। নেহরু কাপে অন্য এক সুনীল ছেত্রীকে দেখা গেল। সেই সুনীল অনেক পরিণত।ফাইনালে এক গোলে পিছিয়ে ভারত। মাঝমাঠ থেকে আলগা একটা বল ধরে শুরু করলেন দৌড়। কেউ বললেন, “জীবনের দৌড়।” কেউ আবার বললেন,”জীবন বাঁচানোর দৌড়।” ক্যামেরুনের সুগঠিত চেহারার ফুটবলাররা ধাওয়া করছেন সুনীলকে। খর্বকায় সুনীলকে রোখে কার সাধ্যি! পেনাল্টি বক্সের ভিতরে ফেলে দেওয়া হল সুনীলকে।’পে-না-ল্টি’, সমস্বরে চিৎকার করে উঠল গ্যালারি। পেনাল্টি নিলেন সুনীল। বেশ কিছুটা দৌড়ে নিলেন শট। বল ক্যামেরুনের জালে। টাইব্রেকারে জিতে নেহরু কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। ফুটবলপাগলরা নস্টালজিক। পুরনো গল্প মনে পড়ছে তাঁদের। ছেলের জন্য রিওয়াইন্ড মোডে বাবাও। টাইম মেশিনের সাহায্য না নিয়ে খড়্গ বলছিলেন, ”২০০২ সালে মোহনবাগানে ট্রায়ালের দিন আমি উপস্থিত ছিলাম। তার পরে ক্লাব ফুটবলে ২২ বছর হয়ে গেল। জাতীয় দলের হয়ে ১৯ বছর। অনেকগুলো দিন কেটে গিয়েছে সত্যি সত্যি।” এই দীর্ঘ সময়ে সুনীল ছেত্রী ফুল ফুটিয়েছেন। মোহনবাগান তাঁর প্রথম ক্লাব। তার পরে দেশের একাধিক ক্লাবের জার্সিতে তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরের এক কক্ষপথে।
আকাশ ছুঁয়েছেন বিখ্যাত এগারো নম্বর জার্সিধারী। আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের ফুটবলে। ফিফা কুর্নিশ জানিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছে, তাঁর ইনস্টা ফলোয়ার ৭ মিলিয়নের বেশি কিন্তু তিনি ক্রিকেট খেলেন না। খড়্গ ছেত্রী বলছেন, ”যা করেছে, খুব ভালোই করেছে। দেশকে গর্বিত করেছে। স্কাই ইজ দ্য ওনলি লিমিট। প্রাইম ফর্মে থাকতে থাকতেই সরে যাচ্ছে ও।”
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিশালাকায় স্টেডিয়ামে সুনীলকে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হবে। দর্শকদের ‘সুনীল-সুনীল’ শব্দব্রহ্ম এর আগেও যুবভারতীতে বসে শুনেছেন খড়্গ ছেত্রী। স্মৃতির পাতা ওল্টাচ্ছেন তিনি, ”আমি দুটো ডার্বি দেখেছি কলকাতায়। একটা মোহনবাগান জার্সিতে। আরেকটা ডার্বির কথা মনে পড়ছে। তখন সুনীল ইস্টবেঙ্গলে। নবির মাইনাস থেকে ও গোল করেছিল।”
দেশের জার্সিতে প্রথম ম্যাচে গোল করেছিলেন ভারত অধিনায়ক। তার পর থেকে সবকটি মাইলস্টোনের ম্যাচেই গোল রয়েছে তাঁর। শেষ ম্যাচেও কি গোল করবেন? দিল্লিনিবাসী খড়্গ ছেত্রী সতর্ক, ”গোল করলে ভালো। না করলেও কিছু না। আমরা ওর গোল, ওর খেলা দেখতে দেখতে অভ্যস্থ। চাপ দেওয়া ঠিক নয়।”
পেনাল্টি স্পট থেকে গোললাইন, পৃথিবীর রহস্যময় সরণী। সেই সরণীতে পথ হারিয়েছেন অনেকেই। বহু যুদ্ধের সৈনিক গত কয়েকবছরে পেনাল্টি নেওয়ার স্টাইলটাই বদলে ফেলেছেন। এক স্টেপে এখন পেনাল্টি নেন। গোলকিপারকে অন্য দিকে ফেলে দিয়ে জালে বল জড়িয়ে দেন। ছেলের খেলা থাকলে কি সংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন বাবা-মা? খড়্গ বলছেন, ”পেনাল্টি মারার সময়ে আমি ওর প্রতিটা স্টেপ দেখি। ওর মা-বন্ধুরা চোখ বন্ধ করে ফেলে। উঠে চলে যায় ঘর ছেড়ে।”
খুব দ্রুত কথা বলেন সুনীল। বল নিয়ে দৌড়নোর মতোই। ছেলের অন্য দিক তুলে ধরছেন বাবা। কিশোর কুমারের গান পছন্দ করেন খড়্গ। সুনীলের পছন্দও পুরনো দিনের গান। মাঝে মধ্যে কিশোর কুমারের গান গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠেন। কথা বলতে বলতে হাসছেন বাবা। সেই হাসি গর্বের।
ছেলেকে নিয়ে কি তিনি একাই গর্বিত? খর্বকায় এক ফুটবল জাদুকর অতীতে বহুবার দেশের সম্মান বাড়িয়েছেন। আন্তর্জাতিক ফুটবল মঞ্চে তিনিই দেশের অহঙ্কার। কিংবদন্তির পায়ের মূর্চ্ছণায় সম্মোহীত হয়েছে এই উপমহাদেশও। তাঁকে বিদায় জানাতে কি এখনই প্রস্তুত আমরা? মনে হয় না। কাশ্মীর থেকে কলকাতার রিংটোন সেই কারণেই, ‘ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.