সন্দীপন গুপ্ত এবং রাহুল দাস: বর্তমান বিশ্বের একটি অন্যতম জনপ্রিয় খেলা হল ফুটবল(World Football)। আধুনিক ফুটবলের সূত্রপাত ঊনবিংশ শতকে। তৎকালীন ব্রিটেনে। যার আজ বিশ্বব্যাপী পরিচিতি। জনপ্রিয়তার নিরিখে ফুটবল একটি আন্তর্জাতিক খেলা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রতি চার বছর অন্তর বিশ্বকাপের আসর বসে। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশেই ফুটবল এখন জাতীয় খেলা। যে কারণে, বিশ্বকাপের পাশাপাশি ইউরো কাপ কিংবা কোপা আমেরিকাও গোটা পৃথিবীতে আজ প্রবল জনপ্রিয়।
জন্মগত ভাবে বিদেশি হলেও ফুটবল ভারতবর্ষেরও অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। বিশেষ করে বাংলার সঙ্গে ফুটবলের এক অনন্য সম্পর্ক। ভারতবর্ষে ফুটবলের প্রবেশ ইংরেজদের হাত ধরে। ১৮৭২ সালে প্রথম ফুটবল ক্লাব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কলকাতা ফুটবল ক্লাব’। সেই সময়ে ফুটবল খেলাটি ছিল ব্রিটিশদের কুক্ষিগত। নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী– যাঁকে ‘ভারতীয় ফুটবলের পিতা’ বলা হয়, তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় ফুটবলের পথ চলা শুরু। তিনিই ১৮৮০ সালে ‘বয়েজ ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। যা ছিল ভারতীয় ফুটবল সংস্থা তৈরির প্রথম ধাপ। পরবর্তী সময়ে তিনি ওয়েলিংটন ক্লাব ও শোভাবাজার ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮৯২ সালে এই শোভাবাজার ক্লাবই প্রথম ভারতীয় দল হিসাবে একটি ব্রিটিশ ফুটবল দলের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে। ১৮৯২ সালের ট্রেডস কাপের উদ্বোধনী ম্যাচে ইস্ট সারে রেজিমেন্টকে ২-১ গোলে পরাজিত করে তারা। ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএফএ) প্রতিষ্ঠাতেও নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। বাংলা তথা ভারতবর্ষে ফুটবল-প্রসারে নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারীর প্রভাব যেমন সর্বজনবিদিত, ঠিক তেমনই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইকে ফুটবলের মাধ্যমে প্রসারিত করেছিল বাংলার ক্লাব মোহনবাগান। বঙ্গভঙ্গ আইনের প্রবর্তন ও তার রদ নিয়ে যখন পরিস্থিতি সরগরম, সেই সময়েই ১৯১১ সালে ফুটবলকে হাতিয়ার করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় গোটা বাংলা তথা দেশ। আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে ২-১ গোলে হারিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও উজ্জীবিত করে তোলে মোহনবাগানের ‘অমর একাদশ’। আবার দেশভাগের পর সহায়-সম্বল হারিয়ে যে মানুষগুলো চলে আসতে বাধ্য হয়, তাদেরও জীবনসংগ্রামের অংশ হয়ে ওঠে সেই ফুটবল– ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের রূপে। সেই কারণেই ফুটবলের প্রতি বাঙালির আবেগ অসীম। সেই কারণেই প্রয়াত সংগীতশিল্পী মান্না দে-র কণ্ঠে অমর হয়ে রয়ে গিয়েছে ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’ গানটি। শুধু কি গান? ফুটবলকে কেন্দ্র করে হয়েছে কত চলচ্চিত্র! যেমন ‘সাহেব’, ‘মোহনবাগানের মেয়ে’, ‘ইস্টবেঙ্গলের ছেলে’, ‘গোলন্দাজ’, ‘এগারো’, ইত্যাদি।
আমরা বাঙালিরা যেমন ফুটবলপ্রেমী, তেমন মৎস্যবিলাসীও বটে। মাছ আমাদের বেশ প্রিয় এবং তাই আমাদের ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’-ও বলা হয়। এবং মাছ ও ফুটবলের মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি করেছে কলকাতার দুই প্রধান মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল। যদিও মোহনবাগান ফুটবল দলের প্রতীক হচ্ছে পালতোলা নৌকা আর ইস্টবেঙ্গলের মশাল। কিন্তু যখন দুই ফুটবল ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে লড়াই হয় তখন এই প্রতীকের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় দুটি মাছ– চিংড়ি ও ইলিশ। ফুটবল ‘ডার্বি’-তে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা উপস্থিত হন চিংড়ি ও ইলিশের ‘কাটআউট’ নিয়ে। মোহনবাগান জিতলে উৎসব হয় চিংড়ি দিয়ে। আর ইস্টবেঙ্গল জিতলে হয় ইলিশ দিয়ে। এ ভাবেই বাঙালির ফুটবল চর্চা এবং মাছের মধ্যে একটা পারস্পরিক ভালোবাসা গড়ে উঠেছে।
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মতো বিশ্বে বেশ কিছু ফুটবল ক্লাব রয়েছে যাদের সঙ্গে মাছ কোনও না কোনওভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এই লেখা তা নিয়েই। প্রথমেই বলি ফ্রান্সের ক্লাব এফসি লরিয়েন্টের কথা। এফসি লরিয়েন্ট ফরাসি ফুটবল লিগের ‘লিগ ২’-এ খেলে। লরিয়েন্ট হল ফ্রান্সের ব্রিটানির একটি উপকূলীয় শহর। যা মাছ ধরার জন্য, বিশেষ করে সার্ডিন মাছ ধরার জন্য পরিচিত। সর্বোপরি, ক্লাবটি লরিয়েন্টের বিখ্যাত মৎস্য ব্যবসায়ী মাদাম কুইসার্ড দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই কারণেই এফসি লরিয়েন্টের লোগোয় সার্ডিন মাছ সে শহরের শক্তিশালী সামুদ্রিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি মাছ ধরার উপর স্থানীয় অর্থনীতির ঐতিহাসিক নির্ভরতার প্রতিনিধিত্ব যেমন করে, তেমনই সেই ক্লাবের জন্মের ইতিহাস এবং তার ঐতিহ্যকেও তুলে ধরে।
এফসি ক্রোটনও তাই। যারা ইতালির তৃতীয় ডিভিশনে খেলে। ১৯১০ সালে এই ক্লাবটির প্রতিষ্ঠা। ‘দ্য শার্ক (হাঙর)’ বা ‘দ্য শার্ক অফ ক্যালাব্রিয়া (ক্যালাব্রিয়ার হাঙর)’ নামে এরা পরিচিত। এবং সেই কারণেই সম্ভবত এই ক্লাবের লোগোয় হাঙরের উপস্থিতি দেখা যায়।
ক্লাবের লোগোতে হাঙরের উপস্থিতি আরও তিনটি ক্লাবের ক্ষেত্রে রয়েছে। যেমন রেডল্যান্ড ভিক্টোরিয়া পয়েন্ট ফুটবল ক্লাব। যা কি না অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন শহরের একটি ফুটবল ক্লাব। যারা খেলে কুইন্সল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল লিগে। ১৯৬৬ সালে এই ক্লাবটির প্রতিষ্ঠা। এরাও ‘দ্য শার্ক’ (হাঙর) নামে পরিচিত। এবং এই ক্লাবের লোগোতেও হাঙর বিদ্যমান। আর একটি হল মেলবোর্নের দক্ষিণ শরহতলিতে অবস্থিত বিউমারিস ফুটবল ক্লাব। ক্লাবটি ভিক্টোরিয়ান অ্যামেচার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অন্তর্ভুক্ত। এদেরও ‘শার্ক’ নামে ডাকা হয়। আর আছে সাদারল্যান্ড শার্কস ফুটবল ক্লাব। যাদের লোগোতেও হাঙর বিদ্যমান। যারা অস্ট্রেলিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফুটবল ক্লাব। ক্লাবটি বর্তমানে ন্যাশনাল প্রিমিয়ার লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এরাও ‘দ্য শার্ক’ (হাঙর) নামে পরিচিত। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে এই তিনটে ফুটবল ক্লাবই অস্ট্রেলিয়ার।
এবার আসা যাক সেই দেশে, যেখান থেকে ফুটবলের উৎপত্তি। মানে ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট সাসেক্সের ‘ওয়ার্থিং’-এর ওয়েস্ট টারিং এলাকায় অবস্থিত ‘ওয়ার্থিং ফুটবল ক্লাব’ হল একটি আধা-পেশাদার ফুটবল ক্লাব, যাদের লোগোতে ম্যাকারেল মাছের উপস্থিতি দেখা যায়। এরা ‘দ্য ম্যাকারেল মেন’ নামেও পরিচিত। দাঁড়ান, আরও আছে। অ্যান্টিগা বারাকুডা এফসি যেমন। ২০১০ সালে এই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হলেও মাত্র তিন বছরের মধ্যে ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যায়। ক্লাবটি ইউনাইটেড স্টেটস লিগ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করত। এদের লোগোতে বারাকুডা মাছের উপস্থিতি লক্ষণীয়। বারাকুডা মাছ তাদের গতি, তৎপরতা এবং হিংস্র প্রকৃতির জন্য পরিচিত। যা ফুটবল দলের পছন্দের বৈশিষ্ট্য। কে বলতে পারে, হয়তো সেই কারণেই ক্লাবের লোগোয় বারাকুডা মাছের স্থানলাভ।
এশিয়াতেও এমন ক্লাব রয়েছে, যাদের সঙ্গে মৎস্য-যোগ বিদ্যমান। ইন্দোনেশিয়ার ৭৫৭ কেপ্রি জায়া এফসি ক্লাব যেমন। তারা বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার তৃতীয় ডিভিশনে খেলে। ৭৫৭ কেপ্রি জায়া এফসি তাদের পতাকায় একটি মাছের লোগো ব্যবহার করে। যার ডাকনাম, ‘ইকান কাকাপ’। যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘স্ন্যাপার ফিশ’। এই ডাকনাম এবং লোগো সম্ভবত স্থানীয় সংস্কৃতি এবং রিয়াউ দ্বীপপুঞ্জের সামুদ্রিক পরিবেশকে প্রতিফলিত করে, যেখানে ক্লাবটি অবস্থিত। ইংল্যান্ডের পিকারিং টাউন ফুটবল ক্লাবকেও বাদ দেওয়ার উপায় নেই। যারা বর্তমানে উত্তর কাউন্টি পূর্ব লিগ প্রিমিয়ার ডিভিশনের সদস্য। ক্লাবের পুরো নাম পিকারিং টাউন কমিউনিটি ফুটবল ক্লাব। যারা পরিচিত ‘দ্য পাইক’ নামে। সেই কারণেই তাদের লোগোতে ফুটবলের পাশাপাশি পাইকের উপস্থিতি আছে। আবার ‘মেক্সিকান ওয়েভ’-এর উৎপত্তি যে দেশে, সেই মেক্সিকোর মানজানিলো এসি সকার ফুটবল ক্লাবের লোগোতে আছে ‘সোর্ড ফিশ’। তবে এক সময় মেক্সিকোর তৃতীয় ডিভিশনে খেলা ক্লাবটির আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই। এ ছাড়াও আরও কিছু ফুটবল ক্লাব আছে যাদের লোগোতে মাছ আছে। যেমন ডোমিনিকার দুব্লাঙ্ক ফুটবল ক্লাব। স্কটল্যান্ডের পিটারহেড ফুটবল ক্লাব।
লেখাটা এবার শেষ করব। আর সেটা করব, চমকপ্রদ একটি তথ্য দিয়ে। শুধু যে মাছের সঙ্গে ফুটবলের যোগাযোগ আছে তা নয়। একটি আস্ত মাছের প্রজাতি রয়েছে, যারা ‘ফুটবল মাছ’ নামে পরিচিত! আটলান্টিক, ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় জলে পাওয়া যা গভীর-সমুদ্রের হিমান্টোলোফাস প্রজাতির অ্যাঙ্গলার ফিশ। যারা ‘ফুটবল মাছ’ নামে পরিচিত। যার গোলাকার ও কিছুটা ফুটবলের মতো শরীরের আকৃতির কারণে এ হেন নামকরণ। এবং ফুটবলের আদি রূপের সঙ্গে (চর্মগোলক, এখনকার মতো দেখতে সুন্দর যা নয়) এর প্রভূত মিলও আছে!
(লেখকেরা কলকাতার ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজের মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.