ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ফাইল চিত্র।
অর্পণ দাস: ‘হয়তো’, ‘সম্ভবত’- কথাগুলোর আর কোনও মূল্য নেই। জল্পনা অতীত। পরের বারও ইউরো কাপ খেলবে পর্তুগাল। নতুন প্রজন্ম, নতুন রক্ত। ইউরোপের সেরা প্রতিযোগিতায় ঘাম-রক্ত ঝরাবেন একঝাঁক উঠতি পর্তুগিজ তারকা। সঙ্গে নিশ্চয়ই পাবেন আজকের দিনের প্রতিষ্ঠিত ফুটবলারদের। থাকবেন না শুধু একজন। ক্যামেরা ঘুরে যাবে গ্যালারির দিকে। এক বহু পরিচিত মুখ সেখানে হাসছেন নতুনদের সাফল্য দেখে। আনন্দে চিৎকার করছেন, গোল মিস হলে আফসোস করছেন। পরমুহূর্তেই উৎসাহ দিচ্ছেন তাঁর দেশ পর্তুগালকে।
না, তখন আর তাঁর গায়ে মেরুন জার্সিটা থাকবে না। পিছনে লেখা থাকবে না সেই বিখ্যাত ৭ সংখ্যাটা। ২০২৮-র ইউরোয় তিনি আর প্রধান নায়ক নন। পার্শ্বচরিত্রও নন। ফুটবলের রঙ্গমঞ্চ থেকে দর্শকের আসনে নেমে আসা এক ‘প্রাক্তন’। যিনি ইউরোয় শেষ ম্যাচ খেলে ফেললেন আজ, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে।
‘শেষ ম্যাচ’, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর (Cristiano Ronaldo) ‘শেষ ম্যাচ’। এখনও ফুটবলবিশ্বকে বিদায় জানাননি তিনি। শুধু ইউরো কাপে (Euro Cup 2024) আর কোনও দিন নামবেন না রোনাল্ডো। তাতেও ‘শেষ ম্যাচ’ শব্দটা লিখতে অস্বস্তি হয়। লিখে ফেলার পর অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। কি-বোর্ডে ব্যাকস্পেস আছে। না বলতে চাওয়া অনেক কথা মুছে ফেলা যায়। কিন্তু জীবন? চরৈবতি মন্ত্রে এগিয়ে চলতে চলতে সে যে কখন নির্মম হয়ে উঠবে, তার আন্দাজ করা ক্ষুদ্র মানুষের কাজ নয়।
কিন্তু আভাস তো ছিল। স্লোভেনিয়া ম্যাচের পর খোদ রোনাল্ডো জানিয়ে দিয়েছিলেন এটাই তাঁর শেষ ইউরো। মাথায় তখনও কথাটা গাঁথেনি। এখনও পুরোপুরি মানতে চাইছে না। সময় বয়ে যাবে নিজের ছন্দে, তখন শূন্যস্থান আরও স্পষ্ট হবে। সারা মাঠময় তাঁকে খুঁজে বেরোবে চোখ। নেই, ইউরোর মঞ্চে ফুটবলার রোনাল্ডো আর নেই। ফ্রান্সের কাছে হেরে তাঁর যে ছবি দেখল ফুটবল দুনিয়া, তা সংক্রামিত হতে থাকবে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ।
ঠিক যেভাবে কুড়ি বছর ধরে ইউরো কাপকে মাতিয়ে রেখেছেন রোনাল্ডো। ১২ জুন, ২০০৪ থেকে ৬ জুলাই, ২০২৪। ফিগোর পাশে ১৭ নম্বর জার্সি থেকে ৭ নম্বর জার্সিকে নিজের নামে পরিচিত করে তোলা। পথের শেষে আজ ডেড এন্ড। পথের দুপাশে অসংখ্য রেকর্ডের মাইলফলক। সবচেয়ে বেশি ৬ বার ইউরো খেলার নজির। ১৪টা গোল, ৮টা অ্যাসিস্ট। শুকনো তথ্য পরিসংখ্যানেই পাতার পর পাতা ভরে যেতে পারে। রেকর্ডের আরেক নাম রোনাল্ডো। রেকর্ডের বাইরেও আছে আরেক রোনাল্ডোর নাম।
২০১৬-র ইউরো জয়। যে কাজ ইউসেবিও, ফিগোরা করতে পারেননি, সেই কাজ করলেন রোনাল্ডো-পেপেরা। কিন্তু একটা কাঁটাও যেন ফুটে থাকে। ম্যাচের ২৫ মিনিটে চোট পেয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দলকে তাতিয়ে গেলেন ১২০ মিনিট। আর সেটা নিয়ে কত কটাক্ষ! আসলে লোকে ভুলে যায়, সেবারের গ্রুপের ছবিটা। ‘এফ’ গ্রুপের শেষ ম্যাচে তিনি জোড়া গোল না করলে যে নকআউটেই ওঠা হত না! সেমিফাইনালে ওয়েলসের বিরুদ্ধে প্রথম গোলটা কার ছিল, সেটাও বোধহয় আলাদা করে মনে করিয়ে দিতে হয়। আরও একটু পিছনে ফিরলে দেখা যাবে ইউরো যোগ্যতা অর্জন পর্বের আই গ্রুপের টপস্কোরারের নাম জনৈক ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো।
আসলে রোনাল্ডো গোল করবেন, ম্যাচ জেতাবেন, এটাই স্বভাবসিদ্ধ ব্যাপার হয়ে গিয়েছে। ব্যতিক্রম হলেই ধেয়ে আসে প্রশ্নবাণ। তাতে অবশ্য লাভই বেশি। ভালোবাসা তাঁকে শক্তি দেয়, আর ঘৃণা-ব্যঙ্গ করে তোলে আরও শক্তিশালী। আর এই মানুষটা ২০১৬-র ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে টাইব্রেকারের আগে সতীর্থ জোয়াও মুতিনহোকে সাহস দেন এই বলে, ‘এবার সব ভগবানের হাতে।’
এবারের ইউরোয় কি তার থেকে আলাদা? তিনি পেনাল্টি মিস করছেন। যে দৃশ্যের সঙ্গে একেবারেই অভ্যস্ত নয় ফুটবল দুনিয়া। তার পর মাঠেই কেঁদে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত পরিত্রাতা হয়ে উঠল গোলরক্ষক দিয়েগো কোস্তার হাত। আবার কিছুটা অতীতে ফেরা যাক। ২০২২-র কাতার বিশ্বকাপ। গ্রুপ পর্বে ঘানার বিরুদ্ধে ম্যাচে চরমতম ভুল করে বসেছিলেন পর্তুগিজ গোলরক্ষক। প্রায় বল তুলে দিয়েছিলেন ঘানার ইনাকি উইলিয়ামসের পায়ে। গোল হলে গ্রুপের ছবিটা বদলে যেত। শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। ম্যাচ শেষে কাঁধ ঝুঁকে গিয়েছে কোস্তার। তাঁকে গিয়ে যেটা বললেন রোনাল্ডো, তার আক্ষরিক অর্থ হতে পারে, “আরে হাসছ না কেন? আমরা তো জিতেছি নাকি! সেটাই আসল কথা। জয় পেয়েছি, এবার মন খুলে হাসো।” সেই কোস্তার হাত তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে।
আর আজ? না, মন খুলে হাসার অবকাশ নেই। শুধুই বিচ্ছেদের বিষাদ। বিদায় পরিচিতা… ইউরো মহাকাব্যের শেষে বিদায় এক যোদ্ধার। রোনাল্ডোর পৃথিবীতে যেমন ঈশ্বরের হাত আছে, তেমনই তিনি প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা নেন। সেই মারের সাগর পাড়ি দিয়ে ২০১৬-র চ্যাম্পিয়ন। এবার হল না। কিন্তু নিজের জন্য পরবর্তী লক্ষ্য নিশ্চয়ই ঠিক করে রেখেছেন তিনি। ২০২৬-এর বিশ্বকাপ। শেষবার সর্বস্ব দিয়ে নিজের পরীক্ষা নেবেন তিনি। নিজেকে প্রমাণ করার পথচলা যে তাঁর ফুরোয় না। পথের দেবতা প্রসন্ন হেসে বলেন, “পথ আমার তখনও ফুরোয় না। চলে, চলে, এগিয়েই চলে…”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.