সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: গ্রীষ্মের দাবদাহে ক্লান্ত একটা শহর। ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে ক্লান্ত দেহ এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে। মাঝেমধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে, মেঘের লক্ষণ আছে কি? হতাশ মাথাটা ঝুঁকে পড়ছে। একটু আশ্বাসের জন্য ভালোবাসা বেঁচে থাকে আজও। বিকেল নামে, শহরের আলোকবৃত্ত ছোট হয়ে আসে। ভিড়ের ব্যস্ততার মধ্যে বড় হতে থাকে গাছেদের ছায়া।
আন্তোনিও হাবাসকে (Antonio Habas) দেখলে মনে পড়তে পারে সেই দীর্ঘ আশ্রয়ের কথা। কোচিং জীবনের সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে তিনি আশার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন মোহনবাগান (Mohun Bagan) সমর্থকের মুখে। না, ‘দিচ্ছেন’ বলাটা ভুল হল। বলা উচিত ‘দিয়েছেন’। শুধু ফুটবল মাঠের নব্বই মিনিটের টিক টিক শব্দের মধ্যে থেমে নেই অস্ফুট আবেগগুলো। যুবভারতীর ৬২ হাজার সিট জানে, কেমন লাগে বারবার জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে। ময়দানের সাদা বড় ফটকটা জানে, কতটা সম্মান জড়িয়ে থাকে সবুজ-মেরুন রঙের জন্য।
হাবাসও জানেন নিশ্চয়ই। তাই তাঁর প্রতিটা পদক্ষেপ ম্যাজিকের মতো দেখতে লাগে। অঙ্কের কলাকৌশলের সঙ্গে মিশে যায় কবিতার না-বলা আবেগ। হাবাস সেই জাদুগর। যাঁর হাত ধরে ফুটবল হয়ে ওঠে প্রত্যাবর্তনের রঙ্গমঞ্চ। চলতি আইএসএলে (ISL) মুম্বই, গোয়া, কেরালার কাছে হার। বহুদিন পর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের কাছে সুপার কাপের গ্রুপ পর্বে হার। চোট-আঘাতে জর্জরিত একটা দল। বিতর্কিত মুম্বই ম্যাচে কার্ডের কবলে পড়েছেন একাধিক ফুটবলার।
তখন এলেন তিনি। সেই প্রবল রৌদ্রে এক টুকরো ছায়ার খোঁজ। হতাশ বাগান জনতা যেন এক ঝাঁকিতে জেগে উঠল। বুমোসের জায়গায় এলেন জনি কাউকো। চাপা আত্মবিশ্বাসে দুলে উঠল পাল তোলা নৌকো। প্রথম ডার্বিতে ড্র। তার পর ফিরে তাকাতে হয়নি। মাঝে অসুস্থ হয়েছেন হাবাস। কিন্তু দলের ভিতরে যে একরোখা জেদ ঢুকিয়ে দিয়েছেন তিনি, তা ঝরে পড়ল সবুজ ঘাসে। হাবাস মানুষটা যেরকম, ঠিক সেভাবেই খেলতে শুরু করল মোহনবাগান। একরোখা, প্রত্যয়ী, শৃঙ্খলাপরায়ণ। বিপদকালে ভেঙে পড়েন না। শুধু জয়ের মন্ত্রে বিশ্বাসী। সেই শক্তিতেই প্রথমবার আইএসএল লিগ শিল্ড জিতে নিল মোহনবাগান। বোঝালেন, এভাবেই ফিরে আসা যায়।
তার পরেও নির্লিপ্ত থাকেন মানুষটি। জানেন কাজ শেষ হয়নি। আসলে কাজ শেষ হয় না। অসংখ্য প্রত্যাশার মধ্যে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লড়াই করার নাম জীবন। আইএসএল খেতাব আসেনি। ভরা যুবভারতীতে হারতে হয়েছে মুম্বই সিটি এফসি-র কাছে। কিন্তু তিনি সোজা দাঁড়িয়ে থাকেন বনস্পতির মতো। স্বীকার করে নেন দুর্বলতা। আপাতত বিদায় নিচ্ছেন না হাবাস। হয়তো মনের মধ্যে জেগে উঠেছে সেই একরোখা জেদ। আগামী মরশুমে স্প্যানিশ মায়েস্ত্রোর মগজাস্ত্রের সঙ্গে সেই জেদ মিশে গেলে ‘সাধু সাবধান!’
এবার লড়াই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এশিয়ার মাটিতে। ফুটবলের মাঠটা ক্রমশ বড় হচ্ছে মোহনবাগান জনতার জন্য। সেদিনের নতুন সূর্যের দিকেই তাকিয়ে থাকবেন সমর্থকরা। তার পর হয়তো চলে যাবেন হাবাস। পৃথিবীতে কোনও কিছুই স্থায়ী নয়। ময়দানে তো নয়ই। তখন পেশাদারি ভঙ্গিতে জানানো হবে স্প্যানিশ বাঁশিওয়ালার বিদায়ের খবর।
সেটাই সব নয়। কোনওদিন হতে পারে না। যুগের পর যুগ ধরে চলতে থাকা সবুজ-মেরুনের ইতিহাসে লিখে যাবেন নতুন ইতিহাস। শুকনো তথ্যের পাহাড় ডিঙিয়ে লক্ষ-লক্ষ সমর্থকের হৃদয়ে থেকে যাবে তাঁর স্মৃতির আশ্রয়। আর হাবাস? কলকাতা থেকে বহু দূর দেশে স্মৃতির পটে ভেসে আসতে পারে তাঁকে নিয়ে জয়ধ্বনির গুঞ্জন। বাংলা কবিতা হয়তো পড়েননি তিনি। নাহলে হয়তো নিভৃতে তাঁর কণ্ঠে শোনা যেত বাঙালির প্রিয় কবির এক কবিতা, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.