শম্পালী মৌলিক: আমরা আলাদা থাকি, কিন্তু একসঙ্গে থাকি। এ কী করে সম্ভব? আপাত অসম্ভব ব্যাপারটাই সম্ভব করেছে প্রেমেন্দু বিকাশ চাকীর ছবি ‘আলাপ’ (Alaap Movie)। মিষ্টি প্রেমের সুবাস নিয়ে এল এই ছবি। গরম উপেক্ষা করে এ ছবির জন্য হলে যেতে ইচ্ছে করবে। পরিচালকের আগের করা ছবিগুলো থেকে এগিয়ে থাকবে ‘আলাপ’। আবির চট্টোপাধ্যায়-মিমি চক্রবর্তী প্রধান চরিত্রে মন কেড়ে নিয়েছেন। অথচ বিনি সুতোয় বাঁধা তাঁদের যাত্রাপথ! আর স্বস্তিকা দত্তর প্রগাঢ় উপস্থিতি এমন, তাঁকে উপেক্ষা করা যাবে না।
প্রধানত, এই প্রজন্মের দুই তরুণ-তরুণী অদিতি-পাবলোকে (মিমি-আবির) ঘিরে ছবির শুরু। কর্পোরেট অফিসে চাকরির সময় এবং বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব, দুটো অচেনা মানুষকে এক জায়গায় এনে ফেলে। ব্রোকার সুখলালের সাহায্যে ফ্ল্যাট পায় পাবলো। হাফ ভাড়ায়। ব্রোকার বলে ফ্ল্যাট অর্ধেক দিন তার, বাকি অর্ধেক অন্যের। রাতে অফিস পাবলোর, দিনে সে বাড়ি থাকবে। অন্যদিকে অদিতি বেহালা থেকে নিউটাউন আসতে নাজেহাল, অফিসে সকাল-সকাল হাজিরার কারণে। ঢপ দিয়ে বেশিদিন চালানো সম্ভব ছিল না। অতএব অফিসের কাছে ফ্ল্যাট নিতে বাধ্য হয়। ঠিক যেমন এ শহরের সেক্টর ফাইভে কাজ করা তরুণ-তরুণীদের জীবনে ঘটে। সকালে অফিস শুরু অদিতির, রাতে তার বাড়ি থাকা। অতএব এদের সাঁকো হল সুখলাল।
পাবলো জানল, দিনে এ বাড়িতে থাকে আদিত্য! ফ্ল্যাট যখন শেয়ার করছে, কিছু কথা তো হবেই। ফ্রিজের গায়ে চিরকুটে সাঁটা থাকে যা কিছু কথা। সেখান থেকে খটকা এবং ভালো লাগার শুরু। খাওয়ার টেবিলে, ফ্রিজে, বসার জায়গায়, জানলার ধারে, ছাদের তলায় দুটো মানুষের যাপন ছাপ ফেলে যায়। একজনের রাখা খবরের কাগজে শব্দছক সলভ করে অন্যজন। ফ্রিজে রাখা খাবারে দুজনেই ভাগ বসায়। একদিন ছেলেটা খুঁজে পায় চেনা সৌরভ, চুল বাঁধার ক্লাচার এবং আরও কত কী! অথচ বাড়িতে তারা মুখোমুখি হয়নি কখনও। তাহলে দেখা কি হয় না? কীভাবে কী হয়, ছবিতে দেখতে হবে।
একটা মানুষের অনুপস্থিতি কতখানি প্রবল ‘উপস্থিতি’ হয়ে উঠতে পারে এই ছবিটা দেখতে দেখতে বোঝা যায়। যত্ন নিয়ে কাহিনি-চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী এবং পদ্মনাভ দাশগুপ্ত। দ্বিতীয়ার্ধে স্বাতীলেখার আবির্ভাব। যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্বস্তিকা দত্ত। স্বাতীও কর্পোরেট চাকুরে। পাবলো আর তার একটা প্রত্যক্ষ সংযোগ তৈরি হয় গল্প এগোলে। অন্তর্মুখী পাবলোর কাছে স্বাতী যেন খোলা জানলা হয়ে ওঠে। ভালোলাগা, মায়াটান আর ভালোবাসার গলিপথে তিনটে মানুষ হাঁটতে থাকে। অনেকদিন পর এমন সহজ সরল, নির্ভেজাল রোম্যান্টিক গল্প দেখলাম।
দেখতে দেখতে মনে হয়, জীবনে যা কিছু ভালোলাগে তাই কি পেতে হয়? পুরো গল্পটা ভাঙব না। হলে গিয়ে দেখার আনন্দই আলাদা। চোখ পিট পিট করা মিতভাষী প্রেমিকের চরিত্রে আবির চমৎকার অভিনয় করেছেন। ভালো লাগে তাঁর কমিক টাইমিং। মিমি তাঁর চরিত্রে সাবলীল। ছবি যত এগিয়েছে মসৃণ হয়েছে তাঁর চলন। একা বসে সুখটান কিংবা গাড়িতে ফেরার নির্জন দৃশ্যে তিনি সবচেয়ে মুখর। স্বাতীর চরিত্রে স্বস্তিকা দত্ত আগাগোড়া ইন্টারেস্টিং। সুখলালের চরিত্রে আর.জে রোহিত গুপ্তকে মানিয়েছে বেশ। প্রতিবেশী মাসিমার চরিত্রে স্বল্প পরিসরে ভদ্রা বসু নিখুঁত। দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায় ও তন্বী লাহা যথাক্রমে পাবলো ও অদিতির বন্ধুর চরিত্রে ঠিকঠাক। বন্ধু সুমনের চরিত্রে কিঞ্জল নন্দর বিশেষ কিছু করার ছিল না।
ছবির সবচেয়ে জোরের জায়গা মিউজিক। প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ‘আলাপ’-এর প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছে। এই ছবিতে অনুপম রায়ের সুরারোপ টাটকা বাতাসের মতো। তাঁর সুরে লগ্নজিতা চক্রবর্তী, সোমলতা আচার্য চৌধুরী আর শ্রেয়া ঘোষালের গান ছবির মেজাজকে সমৃদ্ধ করেছে। তবু বলতেই হয় ছবির দৈর্ঘ্য কম হতে পারত। শেষটা অহেতুক লম্বা মনে হয়েছে। আগে ইতি টানলে পরিণত সমাপ্তি আরও মহার্ঘ লাগত।
সিনেমা – আলাপ
অভিনয়ে – মিমি চক্রবর্তী, আবির চট্টোপাধ্যায়, স্বস্তিকা দত্ত, রোহিত গুপ্ত, ভদ্রা বসু, দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায়, তন্বী লাহা, কিঞ্জল নন্দ
পরিচালনায় – প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.