আকাশ মিশ্র: নিজের বৃত্ত থেকে কোনওভাবেই যে বের হবেন না। তা যেন ফের প্রমাণ করে দিলেন সঞ্জয় লীলা বনশালি। সিনেমার পর্দায় ম্যাজিক তৈরি করার পর, ওটিটিতে যখন পা দিলেন, তখন মনে হয়েছিল, হয়তো ওটিটির জন্য নতুন বৃত্ত তৈরি করবেন। মনে হয়েছিল সেই ‘দেবদাস’, বা বাজিরাও মস্তানি’, ‘পদ্মাবতে’র ‘ক্রাফ্টম্যানশিপ’ ছেড়ে হয়তো ‘খামোশি দ্য মিউজিক্যাল’ কিংবা ‘ব্ল্যাক’ ছবির মতো ‘সেনসেটিভ’ গল্প বললেন। অন্তত, নতুন কোনও চ্যালেঞ্জ নেবেন। কিন্তু ‘হীরামাণ্ডি’ তৈরি করে বনশালি যেন বুঝিয়ে দিলেন তিনি বড্ড বেশি সাবধানী। যে ঘরানায় তিনি অভ্যস্ত তা দিয়েই ওটিটিতে পা রাখলেন। সেই কারণেই নেটফ্লিক্সে সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত ‘হীরামাণ্ডি’ শুধুমাত্র কস্টিউম অপেরাই। বনশালির অন্যান্য কাজের নিময় মেনেই এই ছবির চরিত্ররাও আচরণ করে গেলেন বিশাল প্রাসাদ, ঝলমলে আলো, ভারী গয়না, পোশাক এবং সাদা, কালো ও সেপিয়া টোনে। যেখানে গল্প শুধুই অনুঘটক হয়ে রইল বনশালির ‘ম্যাজিক’-এর কাছে। নাহ, এর অর্থ এই নয় যে, ‘হীরামাণ্ডি’ তৈরি করে ব্যর্থ হয়েছেন বনশালি। এর অর্থ এই নয় যে, এই সিরিজ একেবারেই দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। বরং, এই সিরিজ একটা কথা বার বার মনে করাবে, যে বনশালি বড়পর্দার জন্যই।
তখন ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি’র প্রচারে ব্যস্ত বনশালি। সেই সময় এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ছোটবেলা থেকে যৌবন যে দুকামরার ঘরে তাঁর মা এবং বোনের সঙ্গে থাকতেন, সে বাড়িটির দূরত্ব ছিল মুম্বইয়ের রেডলাইট এলাকার কামাথিপুরা থেকে ঢিলছোঁড়া। তাই খুব কাছ থেকেই যৌনকর্মীদের দেখেছেন তিনি। সন্ধেবেলায় খদ্দেরদের আসা-যাওয়া এবং নিত্য ঝগড়া-অশান্তির সাক্ষীও থেকেছেন। সেই সাক্ষাৎকারে বনশালি এটাও জানিয়ে ছিলেন, এই ঘটনাগুলো তাঁর ‘গাঙ্গুবাই’ তৈরির সময় খুবই সাহায্য করেছিল। বনশালি জানিয়েছিলেন এই ‘কোঠি’, ‘তবায়ফ’ সংস্কৃতি কীভাবে তাঁকে বার বার আকর্ষণ করে। তাই ‘হীরামাণ্ডি’র ছক মগজে এঁকে নিতে বনশালির যে খুব একটা অসুবিধা হয়নি তা এই সিরিজের ৮ টা এপিসোডে পরিষ্কার। কিন্তু তবায়ফের গায়কি, নৃত্যশৈলী এবং দেহব্যবসার মধ্যে যে সূক্ষ্ম তফাৎ রয়েছে সেটাই যেন স্পষ্ট করলেন ‘হীরামাণ্ডি’তে (Heeramandi)। কোনও এক নবাবের ব্যক্তিগত ‘সম্পত্তি’ হয়ে থাকার মধ্যেও যে এক রাজনীতি বা অহংকার রয়েছে, তা হীরামাণ্ডির প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে তুলতে ধরতে চাইলেন বনশালি। আর তা ধরতে গিয়েই বনশালি সাহায্য নিলেন উর্দু শায়েরির। যেখানে উঠে এল গালিব, মীর, জাফর এবং নিয়াজির কলাম। বনশালি কিংবদন্তি এই উর্দু কবিদের থেকে যেন লাইন ধার করে একে একে সাজালেন আলমজেব, বিবোজান এবং ‘হীরামাণ্ডি’র সবচেয়ে উজ্জ্বল হীরে মল্লিকাজানকে। সেই কবিতা দিয়েই সাজালেন ছবির পুরো আবহ। সঙ্গে বনশালি পেয়েছেন মইন বেগের ‘হীরামাণ্ডি’ উপন্যাস।
বনশালির ‘হীরামাণ্ডি’র প্রেক্ষাপট ১৯৪০ সাল। ব্রিটিশ রাজ মুক্ত হওয়ার সংগ্রামে উতপ্ত দেশ। সেই সময়ে নবাবরা দিনের বেলায় ব্রিটিশ শাসকের জুতো লেহনে ব্যস্ত আর রাতের বেলায় তবায়ফের নাচের ছন্দে! বনশালি এর মাঝেই টেনে আনলেন প্রেম, লালসা আর বিশ্বাসঘাতকতার গল্প। একদিকে মল্লিকাজান (মণীষা কৌরালা) এবং অন্যদিকে ফরিদন (সোনাক্ষি সিনহা)। যদি হীরামাণ্ডির ‘নায়ক’ হয় মল্লিকাজান, তো ‘খলনায়ক’ ফরিদন। দুই তবায়ফের ইগোর লড়াই। সম্পত্তির লড়াই। হীরামাণ্ডির ক্ষমতার লড়াই। আর সেই গল্পের একেবারে মধ্যিখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী ইনকিলাব জিন্দাবদ স্লোগান। যা গর্জে ওঠে হীরামাণ্ডির অন্দরেও। এক্ষেত্রে, ‘বিবোজান’ চরিত্রের মধ্যে দিয়ে কানপুরের তবায়েফ আজিজুন বাইয়ের ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইকে বড়মাপে দেখালেন বনশালি।
বনশালির ‘হীরামাণ্ডি’ একাধারে অনেকগুলো গল্প বলে চলে। দেহব্যবসার বাইরেও তবায়ফদের মহলের সংস্কৃতি, শিল্প, রাজনীতি তুলে ধরে। তবে বনশালি কখনই এই গল্প বলতে গিয়ে তবায়ফদের অসহায়তাকে স্পটলাইটে আনেননি। অবশ্যই অনুপ্রাণিত হয়েছেন ‘পাকিজা’ এবং ‘উমরাওজান’ থেকে। কিন্তু সেই চরিত্রগুলো থেকে ‘বেদনা’ ধার করে নেননি বনশালি। বরং স্টাইলকেই ফোকাসে রেখেছেন। হয়তো হীরামাণ্ডির হাত ধরে এত কিছু বলতে গিয়েই ফোকাস থেকে সরে গিয়েছেন বনশালি। তাই হয়তো সঠিক কোন উদ্দেশ্যে গল্প এগিয়েছে তা বেশ অস্পষ্ট। তবায়ফ, স্বাধীনতার লড়াই, নারীত্বের উদযাপন নাকি শুধুই বদলার গল্পের এক কস্টিউম ড্রামা! বনশালি যেন খেই হারিয়ে ফেলেন।
বনশালির এই ‘হীরামাণ্ডি’র সবচেয়ে উজ্জ্বল হীরেই হলেন মণীষা কৌরালা। মল্লিকাজান চরিত্রকে মণীষা যেভাবে আত্মস্থ করেছেন, তা অবাক হয়ে দেখতে হয়। প্রত্যেকটি ফ্রেমে মণীষা অসাধারণ। কঠোর, নিষ্ঠুর হৃদয়কে প্রকটে রেখে, মল্লিকাজান চরিত্র রহস্যের সৃষ্টি করে। যে রহস্য ‘হীরামাণ্ডি’র শেষ এপিসোড পর্যন্ত ধরে রাখেন মণীষা। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য সোনাক্ষি সিনহার জন্যও। ফরিদন চরিত্রে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন যে তিনি, তা প্রতি ফ্রেমেই স্পষ্ট। হতবাক করেছেন অদিতি রাও হায়দারিও। বহু ফ্রেমেই শুধুমাত্র চোখ দিয়ে অভিনয় করেছেন। বহুদিন বাদে ক্যামেরার সামনে ফিরে ফরদিন খান বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি জাত অভিনেতা। এত অভিনেতা ও অভিনেত্রীর মাঝে আলাদা করে নজর কেড়েছেন ‘ফত্তো’ চরিত্রে জয়তী ভাটিয়া, ‘সত্তো’ নিবেদিতা ভার্গভ। নতুন হিসেবে বেশ ভালো তাজদার চরিত্রে তাহা শাহ। কিন্তু হতাশ করেছেন বনশালির ভাগ্নি শারমিন শেহগাল। আলমজেবের মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে শারমিন একেবারেই বেমানান। এমনকী, বনশালির ‘ক্রাফট’-এও যেন বেমানান তিনি। হয়তো ভাগ্নির পরিবর্তে ভালো অভিনেত্রীকে নিতে পারতেন বনশালি।
সবশেষে বলা যায়, ‘হীরামাণ্ডি’ বনশালির অন্যান্য ছবি থেকে একেবারেই আলাদা নয়। নারীকে কেন্দ্রে রেখে গল্প বলার জন্য বনশালি ফের বিশাল আর্ট এফেক্টস, Mise-en-scène – এর সাহায্য নিয়েছেন। ‘হীরামাণ্ডি’ দেখে কোথাও গিয়ে মনে হবে, মোবাইলের পর্দায় বড্ডবেশি বেমানান বনশালি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.