বিশ্বদীপ দে: ‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে’। ১৭৫৭ সাল। পলাশির প্রান্তরে ডুবে গেল স্বাধীন ভারতবর্ষের সূর্য। ব্রিটিশরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই এদেশে এসেছিল। ক্রমে স্থানীয় শাসনের কাজে নাক গলাতে শুরু করে তারা। ধীরে ধীরে একদিন তারাই হয়ে ওঠে শাসক। কিন্তু এমনটা একদিনে হয়নি। পলাশির যুদ্ধের প্রায় দেড়শো বছর আগে দিল্লির বাদশার দরবারে এসেছিলেন স্যার টমাস রো। সেদিন মধ্য পঞ্চাশের নুরউদ্দিন মহম্মদ সেলিম ওরফে জাহাঙ্গির যদি ধরতে পারতেন তাঁর অভিসন্ধি,এদেশের ইতিহাস অন্যরকম হত।
মোঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট ছিলেন জাহাঙ্গির। ১৬০৫ সাল থেকে আমৃত্যু, ১৬২৭ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন দিল্লির অধীশ্বর। ১৬১৫ সালে তাঁর দরবারে আসেন বছর পঁয়ত্রিশের টমাস রো। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের বিশ্বস্ত মানুষটির আর্জি ছিল ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সুরাটে একটি কারখানা খোলার অনুমতি দেওয়া হোক। ১৬১১ সালে সেখানে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল বটে। কিন্তু এবার সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য ইংরেজদের। প্রথমে কেবল এইটুকুই। এদিকে সাহেব সঙ্গে করে এনেছিলেন প্রচুর উপঢৌকন। যার মধ্যে অন্যতম রেড ওয়াইন। অচিরেই যা বাদশাহর প্রিয় পানীয় হয়ে ওঠে।
উইলিয়াম ডালরিম্পলের লেখা ‘দ্য অ্যানার্কি’ নামের বইয়ে এর বিশদ বিবরণ রয়েছে। আসলে রো প্রথম থেকেই নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। তিনি জানতেন, কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করতে উপহারের জুড়ি নেই। এদিকে তিনি ছিলেন এক সুদর্শন সুবেশী রাজপুরুষ। তাঁর সযত্নচর্চিত ছুঁচলো দাড়ি, স্টাইলিশ গোঁফ, উজ্জ্বল চোখ ও বলাই বাহুল্য টকটকে গায়ের রং মুগ্ধ করেছিল জাহাঙ্গিরকে। সব মিলিয়ে জাহাঙ্গির বিদেশি অতিথিকে নিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন। বুঝতেও পারেননি খাল কেটে কত বড় কুমিরটিকে ঢুকতে দিলেন!
তবে টমার রো কিন্তু প্রথম নন। তাঁরও আগে ১৬০৮ সালে একই দাবি নিয়ে দিল্লি এসেছিলেন ক্যাপ্টেন উইলিয়ামস হকিন্স। কিন্তু তাঁকে মোটেই আমল দেননি জাহাঙ্গির। এর পিছনে ছিল পর্তুগিজরা। তারা সেই সময় রীতিমতো একবগ্গা বাণিজ্য চালাচ্ছিল ভারতের সঙ্গে। ফলে জাহাঙ্গির অন্য ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি ছিলেন না। তবে প্রথম থেকেই তিনি সতর্ক ছিলেন। জানতেন দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে ভিনদেশি ব্যবসায়ীদের প্রয়োজন। কিন্তু কোনও একটি দেশকে মাথায় তোলায় তাঁর অন্তত সায় ছিল না। যেটুকু প্রশ্রয় ছিল তা কেবল পর্তুগিজদের জন্যই। এই পরিস্থিতিতে হকিন্স সাহেবকে নিয়ে তাঁর আগ্রহ থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। অথচ কসুর তিনিও কম করেননি। জানা যায়, বাদশাহকে ‘ইমপ্রেস’ করতে আফগানসুলভ পোশাক পরে তাঁর দরবারে হাজির হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু উইলিয়াম ডালরিম্পল জানাচ্ছেন, এসব ‘কায়দা’ মোটেই পছন্দ হয় বাদশাহর। হকিন্সকে ‘অর্ধশিক্ষিত সমুদ্র-কুকুর’ বলে মনে হয়েছিল তাঁর। আর একজন, স্যার মিডলটনও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন।
অথচ টমাস সাহেবের বেলায় ঘটল ঠিক উলটোটা। সবটাই কি উপহার কিংবা ক্যারিশমার প্রভাব? না। আরও একটা বিষয় ছিল। পর্তুগিজদের প্রতি ততদিনে মোহভঙ্গ হয়েছে জাহাঙ্গিরের। ঠিক মোহভঙ্গও নয়, রীতিমতো ক্ষোভ। ১৬১৩ সালে পর্তুগিজরা রহিমি নামে এক মোঘল জাহাজ দখল করে পর্তুগিজরা। যার মালিক ছিলেন জাহাঙ্গিরের মা মারিয়াম-উজ-জামনি। সেই জাহাজে ছিল ১ লক্ষ টাকা এবং বিপুল সংখ্যক হজযাত্রীরা। সেই জাহাজ ফেরাতে রাজি হয়নি পর্তুগিজরা। আর এই কারণেই জাহাঙ্গির রেগে যান। সেটাও একটা ফ্যাক্টর হয় টমাস সাহেবের প্রতি তাঁর সমর্থনের ক্ষেত্রে।
যাই হোক। এহেন পরিস্থিতিতে ১৬১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা জাহাজে চড়ে বসলেন বার্ষিক ৬০০ পাউন্ড বেতনের রাজপুরুষ স্যার টমাস রো। সঙ্গে ডাক্তার, রাঁধুনি, দুজন বাদ্যযন্ত্রী-সমেত লোকলস্করও ছিল জনা পনেরো। মাসছয়েক লেগেছিল ভারতে পৌঁছতে। ততদিনে তিনি নীল নকশা বানিয়ে ফেলেছেন বাদশাহকে খুশি করার। এবং আগেই বলা হয়েছে, সেই পরিকল্পনা কতটা সফল হয়েছিল। আর জাহাঙ্গিরের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নজর করতে থাকেন বিরাট দেশ ভারতবর্ষ এবং তার প্রাদেশিক বিচ্ছিন্নতাকেও। অন্যদিকে জাহাঙ্গির রাজনৈতিক তথা কূটনৈতিক ব্যাপার স্যাপার সেভাবে বুঝতেন না। শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক বাদশাহ মত্ত ছিলেন সেসব নিয়েই। ভোগবিলাসে ডুবে থাকা মানুষটির পক্ষে তাই টমাস সাহেবের অভিসন্ধি বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। এমনও মনে করা হয়, ইংরেজ রাজপুরুষের দেওয়া রেড ওয়াইনই আসল কাজটা করেছিল। কারণ বাকি উপহার যতই জমকালো হোক, সেসব বাদশাহর ঐশ্বর্যের কাছে কিছুই নয়। পারস্যের সম্রাট জাহাঙ্গিরকে হাতি, সোনা-রুপো এসব উপহার দিতেন। দামি পাথর, ঘোড়া এসবও আসত উপহার হিসেবে। কিন্তু বিলিতি মদের আস্বাদ পেড়ে ফেলেছিল জাহাঙ্গিরকে। পরবর্তী সময়ে তাঁর পুত্র শাহজাহানও সেই পানীয় খেয়ে মত্ত হয়ে পড়েন।
ক্রমেই টমাস সাহেবের সঙ্গে জাহাঙ্গিরের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ১৬১৯ সালের মধ্যে সুরাটের বাণিজ্য কেন্দ্র সম্পূর্ণ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ব্রিটিশরাও ইউরোপের বাকি প্রতিদ্বন্দ্বীদের পিছনে ফেলে দিতে থাকে। পর্তুগিজরা উপকূলীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ইংরেজদের ‘পাখির চোখ’ ছিল অন্য়। তারা সূক্ষ্মভাবে প্রভাব বিস্তার করছিল দেশ জুড়েই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বণিকের ছদ্মবেশে ক্রমেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠে। যদিও আরও দেড় শতক লেগেছিল সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে। বাংলার আকাশে স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যাওয়ার সেই করুণ ইতিহাস সৃষ্টি হওয়ার পর। কিন্তু তারও বহু বছর আগে জাহাঙ্গিরই পথ প্রশস্ত করে দেন ব্রিটিশদের। তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভবই হয়নি কীভাবে সুরাটের বাণিজ্য কেন্দ্রের অছিলায় এদেশটাকেই দখল করতে মরিয়া লোভী ইংরেজরা। সেই দূরদর্শিতার মাশুলই গুনতে হয়েছিল দেশকে। পরাধীনতার দিকে যাত্রার সেই ইতিহাসও কম করুণ নয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.