বিশ্বদীপ দে: ভূত, বাঘ, প্রেম ও চোর। চার রকম গল্পই নাকি জমে ভাল। খোদ লীলা মজুমদার একথা বলেছিলেন। তিনি ডাকাতের উল্লেখ না করলেও ধরেই নেওয়া যায়, চোরের গল্প বলতে তিনি ডাকাতকেও বুঝিয়েছিলেন। কেননা ঝাঁকড়া চুল, মাথায় লাল ফেট্টি, কপালে ইয়া তিলক, রক্তজবার মতো চোখ- দল বেঁধে মশাল হাতে হা-রে-রে-রে করে তেড়ে যাওয়া ডাকাতের (Dacoits) গল্প শুনতে কে না ভালবাসে। সেই গল্পের আবেদন কিছু কম নাকি? আর ডাকাতের গল্পে যেগুলো একেবারে ‘কমন’, তার মধ্যে অন্যতম যে ডাকাতি করতে যাওয়ার আগের কালীপুজো (Kali Puja) তা নিয়ে তর্কের কোনও সম্ভাবনাও নেই। ডাকাতদের কালীপুজো নিয়ে মিথ অসংখ্য। সময় বদলে গিয়েছে। সেই ডাকাতরা ‘ভ্যানিশ’। কিন্তু তাদের স্মৃতিবিজড়িত অসংখ্য কালী মন্দির আজও সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের।
রুপোলি পর্দায় গব্বর সিং কিংবা বাস্তবের পৃথিবীতে চন্দন দস্যু বীরাপ্পানদের দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু বাংলার ডাকাতদের চেহারা ও ভাবমূর্তি একেবারেই আলাদা। হাল আমলের অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মুখে রুমাল বাঁধা ডাকাতদের কথা বলছি না। কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পরে যে ডাকাতরা ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের ঘিরেই গল্পগাছা তৈরি হয়েছে। সত্যিই তারা ছিল ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। গত বছর থেকেই রঘু ডাকাতকে নিয়ে সিনেমা তৈরির কাজ শুরু করেছেন টলিউডের তারকা দেব। এই রঘু ডাকাতও কালীপুজো করেই ডাকাতি করতে যেত। সে একা নয়, তার দলের সকলেই। সেই গল্পকে ছুঁতে চাইলে একবার ঘুরে আসতে পারেন কাশীপুরের খগেন চ্যাটার্জি রোডের রঘু ডাকাতের কালী মন্দির থেকে। শোনা যায়, এই মন্দিরের চিত্তেশ্বরী সর্বমঙ্গলা কালী প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রঘু নিজে। মন্দির চত্বরে দেবী সর্বমঙ্গলা ছাড়াও রয়েছে তিনটি শিব মন্দির। একবার জলা অঞ্চলে দেবীমূর্তি ও মহাদেবের মূর্তি দেখতে পেয়েছিলেন রঘু ডাকাত। পরে দেবী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন। সেই আদেশ মেনেই নাকি ওই মূর্তিকে অধিষ্ঠিত করেন তিনি।
বাংলার আরেক বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত) ডাকাত বিশে ডাকাত। তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে বুনো কালীর মন্দির। হুগলির ডুমুরদহের বিশে ডাকাতের ভয়ে কাঁপত সাধারণ গৃহস্থ। আবার দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইংরেজ সরকারও থাকত তটস্থ। শোনা যায় নৌকায় চেপে হুগলি থেকে সদলবদলে একেবারে যশোর পর্যন্ত চলে যেতেন বিশে ওরফে বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ডাকাতি করে গঙ্গার পাড়েই বিরাট বাড়ি তৈরি করেছিলেন তিনি। ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে কালীপুজো করে তবে বেরতেন বিশে ডাকাত।
ডাকাতকালীর গল্প কেবল রঘু ডাকাত বা বিশে ডাকাতের আরাধনাতেই শেষ হয়ে যায় না। যেমন অধুনা মনোহরপুকুর রোডে পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ছিল ঘন জঙ্গল। সেখানে দাপিয়ে বেড়াতেন মনোহর ডাকাত। যে দর্শনার্থীরা কালীঘাট মন্দিরে যেতেন, তাঁদের ফেরার পথে আচমকাই জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসত ডাকাতের দল। সর্বস্ব লুঠে নিত নিরীহ পথিকদের। এই মনোহর ডাকাতই করতেন ছানা কালীর পুজো।
এই ভাবেই মোটামুটি ভাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলার বিভিন্ন গ্রাম ও জনপদে গড়ে উঠতে দেখা গিয়েছিল ডাকাতকালীর থান বা মন্দির। এমন বহু মন্দিরের গল্প আমাদের জানা। আবার অখ্যাত গ্রামে গেলেও শোনা যায় রোমাঞ্চকর কোনও ডাকাতকালীর গল্প। কিন্তু কেন? কেন ডাকাতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে কালীপুজো? এর সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বসলে মনে হয়, পশ্চিম বা উত্তর ভারতের মতো বংশানুক্রমিক ডাকাতিকে ‘পেশা’ হিসেবে বেছে নেওয়ার প্রবণতা এই বাংলায় আদৌ ছিল না। যদিও ‘চৈতন্য ভাগবত’-এর মতো গ্রন্থে ‘নিরন্তর এ পানিতে ডাকাত ফিরে’র মতো বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, বাংলার ডাকাতের ইতিহাস নেহাত পুরনো নয়। তবুও একথা অনস্বীকার্য, ইংরেজ শাসনের ধাক্কায় বাংলার আর্থ-সামাজিক জীবন প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলেই বহু মানুষ কার্যত পেটের দায়ে হাতে ধারালো অস্ত্র তুলে লুঠতরাজের পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। আর সেই কারণেই হয়তো এঁদের মনের মধ্যে একটা বিবেকবোধ জেগে থাকত। সচেতন ভাবে না হোক অবচেতনে। ‘পাপবোধ’ থেকেই মা কালীর কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাংলার ডাকাতরা, এমনটা বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না। হয়তো সেই কারণেই লুণ্ঠিত সম্পদের বড় একটা অংশ দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিত তারা।
কালীভক্ত ডাকাতদের ধর্মভীরুতার পক্ষে একটা গল্পের কথা বলা যেতে পারে। মহারানি সুনীতি দেবীর লেখা ‘বাংলার ডাকাত, বাংলার বাঘ’ বইয়ে সেই গল্প রয়েছে। এক বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। যেহেতু ডাকাতরা চিঠি দিয়ে ডাকাতি করতে আসত, তাই বাড়ির কর্তাব্যাক্তিরা গয়নাগাটি, টাকাকড়ি নিয়ে আগেই সরে পড়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়িতে রয়ে গিয়েছিলেন এক মহিলা ও একটি ছোট্ট মেয়ে। ডাকাত পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙেছিল সেই বালিকার। বিপদ থেকে কী করা বাঁচা যায়, একথা ভাবতে গিয়েই তার মনে পড়ে গিয়েছিল নিজের গায়ের রঙের কথা। শ্যামবর্ণা সেই ছোট্ট মেয়ে এরপর কালী সেজে মুখোমুখি হয় ডাকাতদের। ব্যাস! ডাকাবুকো ডাকাতরা সঙ্গে সঙ্গে পায়ে পড়ে যায় দেবীরূপী সেই কন্যার। সিদ্ধান্ত নেয়, আর এই বাড়িতে নয়। তারপরই পত্রপাঠ পিঠটান।
এই গল্প সত্য়ি হতে পারে, মিথও হতে পারে। যেটাই হোক, ডাকাতদের ধর্মভীরুতার দিকটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বোঝা যায়, হাতে অস্ত্র, কানে মাকড়ি আর কপালে তিলক কেটে যতই তারা ভীষণদর্শন হয়ে উঠুক ভিতরে ভিতরে একধরনের বিবেক দংশন কাজ করতই। আর তাই তারা নিজেদের দেবীর পায়ে সঁপে দিত। কালীর উপাসনা করে লঘু করতে চাইত নিজেদের পাপের ভার। গল্পটি বানানো হলেও এর ভিতরে থাকা এই সত্যকে বোধহয় অস্বীকার করা যায় না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.