Advertisement
Advertisement
Swadesh Deepak

কলকাতায় মায়াবিনীর পাল্লায় পড়েই উন্মাদ! ১৮ বছরেও খোঁজ মেলেনি বিখ্যাত সাহিত্যিকের

স্বদেশ দীপকের কাহিনি যেন হার মানায় গল্পকথাকেও।

Strange life of Hindi writer Swadesh Deepak
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:June 22, 2024 8:47 pm
  • Updated:June 22, 2024 8:53 pm  

বিশ্বদীপ দে: টেবিলে পড়ে আছে চশমা। পাশে মানিব্যাগ। পকেটে থাকা বাকি কাগজপত্রও সেখানে রাখা। যেন এখনই ফিরে আসবেন তিনি। কিন্তু সেই যে ভোরবেলা এসব রেখে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে গেলেন মানুষটি, আর ফিরে আসেননি। কেটে গিয়েছে ১৮ বছর। কোনও সন্ধান মেলেনি স্বদেশ দীপকের। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন স্বনামধন্য এই হিন্দি নাট্যকার ও ছোটগল্পকার। এর আগে জীবনের সাতটি বছর কেটেছে মানসিক অসুখে ছিন্নভিন্ন হয়ে। যার সূত্রপাত ঘটেছিল এই কলকাতাতেই। স্বদেশ লিখেছিলেন, ‘কলকাতা। ১৯৯১ সালের একাদশতম মাস। মায়াবিনী আমার মাথায় নখ বিঁধিয়ে দিল। আমি পরে সেটা বুঝেছিলাম। অনেক পরে। আমার পৃথিবীটা ঝলমলে রঙিন থেকে একরঙা, অসুস্থ ও কুৎসিত হয়ে গেল।’ স্বদেশ দীপকের জীবনের এই অংশ আজও রয়ে গিয়েছে আশ্চর্য বিষণ্ণ এবং একই সঙ্গে অসম্ভব রহস্যময় এক কুয়াশায় ঢাকা। যার কেন্দ্রে রয়ে গিয়েছে ‘ম্যায়নে মান্ডু নেহি দেখা’। মধ্যপ্রদেশের (Madhya Pradesh) প্রাচীন জনপদের ধ্বংসাবশেষ কীভাবে হয়ে উঠল তাঁর জীবনের ‘সর্বনাশ’? কেই বা সেই মায়াবিনী?

২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘ম্যায়নে মান্ডু নেহি দেখা’ নামের একটি বই। উনবিংশ শতকের কিংবদন্তি সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পোর লেখায় বার বার ধাক্কা দিয়েছে উন্মাদনা। পরবর্তী সময়ে লাভক্র্যাফট থেকে শুরু করে অনেকের লেখাতেই এমনটা দেখেছে পাঠক। উন্মত্ততা নিয়ে লিখিত হয়েছে বহু আকরগ্রন্থ। কিন্তু স্বদেশ যা করেছেন, তা বোধহয় আর কেউ করেননি। তিনি তাঁর উন্মত্ত অবস্থার মানসিক চলনের বর্ণনা করেছেন। যা ভাবিয়ে তোলে মনোবিদদেরও। এবং তা কোনও ফিকশন নয়। রক্তমাংসের ভিতরে বয়ে চলা অস্থিরতার ‘বাস্তব’ খতিয়ান। এই সব কিছুর সূচনাবিন্দু ধরা হয় কলকাতাকে। ততদিনে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছেন স্বদেশ। তাঁর ‘কোর্ট মার্শাল’ এক অতি বিখ্যাত নাটক। গোটা দেশে তা অভিনীত হয়েছে। যা প্রথম প্রথম প্রদর্শিত হয় ১৯৯১ সালেই। ততদিনে অবশ্য অসংখ্য ছোটগল্প, দুটি উপন্যাস এবং আরও চারটি নাটক লেখা হয়ে গিয়েছে তাঁর। অসম্ভব জনপ্রিয় স্বদেশ যেন খ্যাতির শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে ফেলেন ‘কোর্ট মার্শাল’-এ।

Advertisement

[আরও পড়ুন: ‘বাংলাদেশিদের জন্য চালু হবে ই-মেডিক্যাল ভিসা’, হাসিনা সাক্ষাতে বড় ঘোষণা মোদির]

নভেম্বরের যে সন্ধ্যায় প্রথম মায়াবিনীর দেখা পেলেন তিনি, সেদিন কলকাতায় অভিনীত হচ্ছিল নাটকটি। সবে শেষ হয়েছে শো। দর্শকরা এসে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছেন তাঁকে। ঠিক তখনই এক সুন্দরী মহিলা এগিয়ে এলেন তাঁর দিকে। নাটকের প্রবল প্রশংসা করলেন। তার পরই বলে বসলেন, ”ম্যায়নে মান্ডু নেহি দেখা।” চারপাশের ভিড়, গুঞ্জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এমন এক কথা শুনে যেন খেই হারিয়ে ফেললেন স্বদেশ। মান্ডু মধ্যপ্রদেশের রানি রূপমতী ও বাজ বাহাদুরের মহলের জন্য খ্যাত। কবেকার এক হারানো ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নাটকের তো কোনও সম্পর্কই নেই! তাহলে? এদিকে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে অধীর আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আরও অনেকে। অধৈর্য ও বিরক্ত স্বদেশ বললেন, ”তাহলে যান। গিয়ে দেখে আসুন মান্ডু।” উত্তর আসে, ”আমি মান্ডু আপনার সঙ্গেই দেখতে চাই।” মুহূর্তে সব বাঁধ ভেঙে যায় যেন। চিৎকার করে ওঠেন স্বদেশ, ”ইউ ব্লাডি উওম্যান! কী মনে করেছেন আমাকে? আমি এক পুরুষ যৌনকর্মী নাকি?”

কিন্তু অচিরেই স্বদেশকে জানানো হয় ওই মহিলা একজন নামী ডাক্তার। হিন্দি নাটকের বিশেষ অনুগ্রাহী। একথা জানার পর কেমন একটা অপরাধবোধ ঘিরে ধরে তাঁকে। ক্রমে আলাপ গড়ায়। ওই মহিলা নিজের গাড়িতে গেস্ট হাউসে পৌঁছে দেন স্বদেশকে। পরদিন নাকি নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। নিজের হাতে রান্না করা খাবার খাওয়ান। এবং আগাগোড়াই যেটা স্বদেশকে অবাক করে, মহিলা একবারের জন্যও সর্বসমক্ষে ভর্ৎসনার কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। বরং তাঁর ব্যবহার অতিশয় মধুর। যেন একটা জাদুতে আচ্ছন্ন হতে থাকেন। তাঁকে মুগ্ধ করে ওই রমণীর রূপ। মনে হতে থাকে এ তো ‘হেলেন অফ ট্রয়’।

[আরও পড়ুন: তিস্তা চুক্তি নিয়ে সদর্থক বার্তা মোদির, ভারতকে ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ বললেন হাসিনা]

এই মুগ্ধতাই যেন হয়ে উঠতে থাকে মায়াবিনীর প্রতিশোধ! ধীরে ধীরে মানসিক স্থিরতা হারিয়ে ফেলতে থাকেন স্বদেশ দীপক। সব হিসেবের কড়ি এলোমেলো হয়ে গেল। প্রায় সাত বছরের জন্য বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলেন তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘আমার নদী হারিয়ে গিয়েছিল। কোথাও আমার জন্য কোনও সেতু ছিল না। সাত বছরের জন্য আমি ছিলাম মানসিক অসুখে বন্দি। যাঁরা এমন অসুখে আক্রান্ত হন তাঁরা দেখতে থাকেন ভয়ংকর স্বপ্ন, যেগুলির প্রতিক্রিয়াও হয় একাধারে ভয়ংকর ও ঘৃণায় ভরা।’ হাসপাতালে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার সময় বলেছিলেন, ”আমি আপনার কথার উত্তর দিচ্ছি যেন টেলিফোনে। যেন এমন এক দেশে আছি যেখানে কেউ ভাষায় কথা বলে না।”

‘ম্যায়নে মান্ডু নেহি দেখা’ এমন এক বই যা পড়তে আরম্ভ করলে বিষাদ ও চাপা আতঙ্ক যেন গ্রাস করতে থাকে পাঠকের মন। সেই বইয়ের শুরুতেই ভূমিকায় এই কথাগুলি লিখেছিলেন স্বদেশ। জানিয়েছিলেন, তাঁর মাথার ভিতরের সব সবুজ যেন শুকিয়ে গিয়েছিল। কোথাও কোনও পাখি আর অবশিষ্ট ছিল না। আর এই সময়ে একজন যেন থেকে থেকে ফিরে এসেছে তাঁর জীবনে। তিনি চোখের সামনে দেখতে পেয়েছিলেন মায়াবিনীকে। সে যেন তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। কখনও সে একা আসছে। কখনও তার সঙ্গে তিনটি সাদা চিতাবাঘ। কখনও কখনও তার হাসি বাড়তে বাড়তে অসহ্য হয়ে ওঠে। বাতাসে ভেসে আসতে থাকে ফিসফিস। সেই শব্দ যেন ঢেকে ফেলতে থাকে চরাচর।

নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন স্বদেশ। সোয়েটার পরে উপুড় হয়ে পড়েন গ্যাস ওভেনের উপরে। দগ্ধ শরীরে ভর্তি হলেন হাসপাতালে। একদিকে ক্ষতবিক্ষত শরীর, অন্যদিকে ঝলসানো মন। পরেও বার বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে গিয়েছেন। ক্রমে ধীরে ধীরে সুস্থতার দিকে ফেরা। ২০০৪ সালে পেলেন সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার। কিন্তু সেই হারানো মন আর ফিরে এল না যেন। থেকে থেকেই হয়ে উঠতেন অস্থির। স্ত্রী গীতা, পুত্র সুকান্ত, কন্যার কাছে একজন ‘আগন্তুক’ই হয়ে থেকেছিলেন ২০০৪ সাল পর্যন্ত। ছেলে সুকান্ত জানিয়েছিলেন, বাবার আতঙ্কে তিনি লোহার রড রেখে দিতেন বিছানার নিচে। কেননা স্বদেশ নিজেকে যেমন আঘাত করতেন, বাধা দিলে চড়াও হতেন সেই মানুষটির উপরেও! ২০০৬ সালে ফের পৌঁছে যাওয়া উন্মত্ততার চূড়ান্ত বিন্দুতে। নিজের ছোটগল্প নিজেই আগুনে পুড়িয়ে দিতে শুরু করলেন স্বদেশ। তার পর… একদিন হারিয়ে গেলেন কোন রহস্যময় কুয়াশার ভিতরে।

নিজের চিকিৎসককে বলেছিলেন, এমন এক কাহিনি লিখছেন যেখানে এক ব্যক্তি দূরপাল্লার ট্রেনে ভ্রমণ করার সময় মাঝরাতে নেমে যাচ্ছেন এক অজানা স্টেশনে। যেন ওই স্টেশনই তাঁর গন্তব্য। চিকিৎসক অবশ্য বোঝেননি আসলে নিজের কথাই বলছেন স্বদেশ। কেননা কদিন পর তো তিনি নিজের বাড়ি ছেড়ে পাড়ি দিলেন অজানা কোন স্টেশনের দিকে! যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। তাঁর নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গে ছেলে সুকান্ত বলছেন, ”যেদিন আমার মা, বোন আর আমি বুঝতে পারলাম উনি আর ফিরে আসবেন না সেদিন সকলেই যেন স্বস্তি পেলান। প্রায় উদযাপন করার মতো পরিস্থিতি হল। আমার বোন বলে, আর যেন ওঁর মুখ দেখতে না হয়। আমারও সেই আকাঙ্ক্ষা। আমার মায়েরও।” এই সংলাপই বুঝিয়ে দেয় নিজের ভিতরে উবু হয়ে বসে কোন অতলে আগেই তলিয়ে গিয়েছিলেন স্বদেশ। পরিবারের কাছেই হয়ে উঠেছিলেন ভয়ংকর এক ‘ঝঞ্ঝাট’! তাঁর চেতনা জুড়ে তখন কেবলই বুঝি মায়াবিনী ও তাঁর প্রতিশোধ। যার সামনে আপনজনরাও হয়ে ওঠে আগন্তুক। নিজের বাড়িও হয়ে যেতে থাকে এক অচেনা পৃথিবী। মাথার ভিতরে জেগে ওঠে পাখিহীন, ধূসর এক জগৎ!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement