রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম শীতের এই বৃষ্টি হঠাৎ আসেনি কিন্তু। এসেছে এক হারিয়ে-যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের বার্তাবাহী হয়ে। কেউ এই ঝড়ের নাম দিয়েছেন ‘জাওয়াদ’। কেউ ডেকেছেন ‘উদার’ নামে। এখন এই ঝড় রূপান্তরিত প্রথম শীতের বাদলধারায়! কাল সারারাত নাছোড় বৃষ্টি হয়েছে। সারাবেলা বাদল ছাড়ার নাম নেই। বেশ লাগছে আমার প্রথম শীতের এই অকাল-বর্ষা। একশো বছর আগে, শীত-সবে-পড়ছে এক রাত্তিরবেলা, রাতভর বৃষ্টিতে জেগে আছেন অবন ঠাকুর! আর একা ঘরে, হয়তো বা পিদিমের আলোয়, লিখে ফেলছেন ‘কুঁকড়ো’ নামের এক ভারি রোম্যান্টিক কবিতা, কোনও এক ‘সোনালিয়া’-র উদ্দেশে। কোথায় কোন চুলোয় গিয়েছে অবন ঠাকুরের সেই চিলতে কবিতার বই, এখন আর ঠাওর নেই। শুধু মনে আসছে খাপছাড়া কয়েকটি লাইন ‘সোনালিয়া, প্রায় সবই তো শুনলে, আরও যদি চাও তো বলি, অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভোররাতের হিম মাটি এই যে কাঁদন জানাচ্ছে আকাশের কাছে তার অর্থ কী, সোনালিয়া।’ কাল সারারাত হিম রাতে বৃষ্টির শব্দ শুনতে-শুনতে আমার মনে হয়েছে অন্তত একশো বছরের পুরনো মেয়ে ওই সোনালিয়া-কে। প্রথম শীতের অকালবর্ষণ না এলে, হিম মাটির রাতভর কান্না না শুনলে, সোনালিয়াকে মনে পড়ত না, সে মেয়ে যেই হোক না কেন।
একটি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ না এনে পারছি না। প্রসঙ্গটি মৃত্যুর। কাল হিমরাত্রে বৃষ্টি পড়ছে। অঝোরে বৃষ্টি। একা ঘরে জেগে ভয় পেয়েছি আমি। বাইরে অনাকার অন্ধকার। শীতের রাত্রে মুষলধারে বৃষ্টি পড়লে আগে কি এমন অসহায় লাগত? হয়তো না। কাল লেগেছে। মনে হয়েছে পৃথিবীতে কেউ নেই যে আমার কোনও প্রয়োজনে এখন সাড়া দিতে পারে। শুধু শীত। আর অন্ধকার। আর বৃষ্টি। আর আমার লেপের মধ্যে আবৃত অসহায়তা। শীতের বর্ষা ছাড়া হয়তো এইভাবে ভাবতাম না। এই যে ঝাপসা আর্তি, এরও প্রয়োজন আছে জীবনে।
প্রথম শীতের এই প্রবল বর্ষণ। যার মধ্যে অনিশ্চিত, নিঃসঙ্গ, কিছুটা আর্ত আমি, শুয়ে আছি লেপের উষ্ণতায়, ভালও তো লাগছে আমার! এই অহেতুক ত্রাস, ওই অনিশ্চয়তা ও নিঃসঙ্গতা হঠাৎ পাওয়া গয়নার বাক্সের মতো। ঝলমল করছে অন্ধকারের মধ্যে। জীবনে এখনও এত মণিমুক্তো! কে জানত! রবীন্দ্রনাথেরই একটি অকালবর্ষার গান, শীতরাত্রির বর্ষার মধ্যে, ছুটে এল আমার কাছে! তার যাত্রাপথে গানটি নিজেই পালটে নিয়েছে একটিমাত্র শব্দ : ‘কোন খ্যাপা শ্রাবণ ছুটে এল অঘ্রানেরই আঙিনায়!’ সংস্কৃত নাম তো ‘অগ্রহায়ণ’। কেন অগ্রহায়ণ? কারণ বহু বছর আগে এই মাসই ছিল মার্গশীর্ষ। সাহেবদের মতো বাঙালিরও বছরের প্রথম মাস ছিল শীতের মাস! আর হলই বা শীত, শীতের বর্ষাই তখন ছিল বছরের প্রথম ধৌতির বর্ষণ। অনেক রাত্রে কাল, শীতের অকাল বর্ষণের মধ্যে, হঠাৎ মনে এল এই ভাবনাটিও – এই বৃষ্টি মহামারীর শেষে নতুন শুরুর পবিত্র বর্ষণ! মনপ্রাণ ভরিয়ে দিলেন চিরদিনের অনন্ত রবীন্দ্রনাথ, নিজেকে সামান্য বদলে নিয়ে :
আমার প্রথম শীতের বাদল ধারা
আমার স্বপনলোকে দিশাহারা॥
ওগো অন্ধকারের অন্তরধন, দাও ঢেকে মন পরান মন–
আমি চাইনে তপন, চাইনে তারা॥
আমার প্রথম শীতের বাদল ধারা॥
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.