বিশ্বদীপ দে: শুরুটা করা যেতে পারে টিনটিন (Tintin) দিয়ে। কমিক্সের নাম ‘দ্য কাস্টাফিওর এমারেল্ড’। বাংলায় ‘পান্না কোথায়’। বহু প্রজন্মের শৈশব ছুঁয়ে থাকা টিনটিনের এই অ্যাডভেঞ্চারের কথা ভাবলেই কথা বলা টিয়া, কিংবা নামী গায়িকার সঙ্গে হ্যাডকের মিঠে খুনসুটির সঙ্গেই মনে পড়ে যায় জিপসিদের (Gypsies) দলের কথা। যাযাবর (Nomadic) শ্রেণির সেই এক দঙ্গল মানুষের উপরে এসে পড়েছিল পান্না চুরির সন্দেহ। পরে অবশ্য দেখা যায়, তারা নির্দোষ। কমিক্সের আপাত মজার ভিতরেও কোনও কোনও সংলাপ এসে সটান বিঁধে যায়। যেমন একটি দৃশ্যে এক জিপসি যুবক বলে ওঠেন, ‘‘তোমার কি ধারণা আমরা শখ করে ডেরা বেঁধেছি এখানে? নোংরার মধ্যে থাকতে খুব মজা লাগে আমাদের?’’
চালচুলোহীন, অসহায় মানুষগুলোর দুর্দশা স্পষ্ট ফুটে ওঠে সেই মুহূর্তে। অথচ জিপসিরা মোটেই শিকড়হীন নয়। আর তাদের শিকড় জড়িয়ে রয়েছে আমাদের দেশের সঙ্গে। হ্যাঁ, ভারত থেকেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এই যাযাবর শ্রেণি। যাদের বলা হয় রোমা জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর তিন ভুবনজয়ীর নাম চার্লি চ্যাপলিন (Charlie Chaplin), এলভিস প্রেসলি (Elvis Presley) ও পাবলো পিকাসো (Pablo Picasso)। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, ‘রক অ্যান্ড রোল’-এর সম্রাট এবং কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী। সারা পৃথিবী মাতিয়ে রাখা এই মানুষগুলির রক্তেও মিশে রয়েছে যাযাবর ওই জনগোষ্ঠীর রক্ত। অর্থাৎ সুদূরপ্রসারী অর্থে তাঁদের শিকড় এই ভারতেই। এই তালিকা আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে তোলাই যায়।
রোমা (Roma), রোমানি কিংবা জিপসি। নানা নামেই তারা পরিচিত। নানা দেশে নানা রকম। ব্রিটেনে জিপসি, সুইডেনে তাতারা, স্পেনে গিটানো- এমন কত। ভারত থেকে ক্রমে ইউরোপ-সহ সারা পৃথিবীর সব মহাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে বনজারা, গুজ্জর, সান্সি, চৌহান, সিকলিগর প্রভৃতি যাযাবর জনগোষ্ঠীর মানুষরা। তাদের ভাষার নাম রোমানি। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার প্রভাব রয়েছে সেই ভাষায়। সেই সঙ্গে যখন যে দেশে তারা পৌঁছেছে সেই ভাষাকেও আপন করে নিয়েছে রোমারা। কিন্তু কেন তাদের এভাবে ঘরছাড়া হতে হল? কীভাবে গোটা পৃথিবী হয়ে উঠল তাদের ঘর?
আসলে দীর্ঘ সময় ধরেই এই জনগোষ্ঠীর মানুষরা নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর অন্যত্র। ‘ব্রিটানিকা’র তথ্য অনুসারে, একাদশ শতকে পারস্য, চতুর্দশ শতকে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পঞ্চদশ শতকে পশ্চিম ইউরোপ এভাবে ছড়িয়ে যেতে যেতে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এসে দেখা যায়, প্রতিটি মহাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে রোমারা। আবার কোনও কোনও ইতিহাসবিদ মনে করেন, একাদশ শতাব্দীরও বহু আগে আলেকজান্ডার ভারতে আসার সময় অস্ত্র নির্মাণে রোমাদের নৈপুণ্য দেখে অনেককেই বন্দি করে সঙ্গে নিয়ে যান। কেউ কেউ আবার মাহমুদ গজনির কথাও বলেন। ইতিহাসের বুক খুঁড়ে খুঁজে পাওয়া এই নানা সম্ভাবনা থেকে শেষ পর্যন্ত একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়। বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও রোমা জনগোষ্ঠী আসলে ঠাঁইনাড়া স্বভাবের। তাদের পায়ের তলায় যেন সরষে। বিক্ষিপ্ত ভাবে বিভিন্ন সময়ে তাই এক দেশ থেকে অন্য দেশে বয়ে চলাই যেন ভবিতব্য হয়ে ওঠে তাদের। তবে যাঁরা যেখানে থিতু হয়েছেন সেখানকার ভাষা-সংস্কৃতিকে আপন করে নিতে পেরেছেন দ্রুত।
কিন্তু তবু শেষ পর্যন্ত ‘বিদেশি’ তকমাই যেন জুতে যায় রোমা গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে। টিনটিনের কমিক্সেও শ্বেতাঙ্গরা তাদের কীভাবে সন্দেহের চোখে দেখে তা পরিষ্কার হয়ে যায় যখন ক্যাপ্টেন হ্যাডককে সেই বাড়ির ভৃত্য পর্যন্ত অক্লেশে জানায়, ‘‘জিপসিরা এক নম্বরের চোর। ওরা ঝামেলা পাকাবে।’’ এই সংলাপেই যেন পরিষ্কার হয়ে যায় জিপসিদের ভাবমূর্তি। তবে ঠাঁইনাড়া যাযাবর হয়ে ওঠার সবথেকে বড় খেসারত তাদের দিতে হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। হিটলারের ‘হলোকাস্ট’ কিংবা ইহুদি হত্যার সেই ঘৃণ্য ইতিহাস সকলেরই জানা। কিন্তু নাৎসিদের অত্যাচারে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় দ্বিতীয় নামটিই যে রোমা কিংবা রোমানিদের, তা অনেকেরই স্মরণে থাকে না। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৫। ‘রোমানি হলোকাস্ট’-এর মোট শিকার কত কে জানে! কোনও হিসেব বলছে দেড় লক্ষের কাছাকাছি। আবার কোনও হিসেব ৮ লক্ষ। আবার ১৫ লক্ষেরও বেশি রোমানির মৃত্যুর কথাও উঠে আসছে হিসেবে। ইহুদিদের সঙ্গে সমগোত্রীয় হিসেবে ‘শত্রু’ চিহ্নিত করে অবাধে নারকীয় হত্যালীলা ও নির্যাতন চালানো হয়েছিল তাদের উপরে।
তবু দমিয়ে রাখা যায়নি রোমানিদের। অদম্য উদ্দীপনায় জীবনকে ভালবেসে তারা তাদের মতো করে গড়ে তুলছে তাদের পৃথিবী। দীর্ঘ ক্যারাভ্যান। অর্থাৎ গাড়ির সারি। ট্রাক, ট্রলার আরও নানা রকম। দল বেঁধে এগিয়ে চলেছে যাযাবর জনগোষ্ঠীর এই মানুষেরা। এমনই ছবি খুঁজে পাই ‘ব্রিটানিকা’র বর্ণনায়। বহু রোমানিই তো ঘর বেঁধেছেন। তবু আজও অনেকেই ভবঘুরের জীবনযাপন করে চলেছেন। সারা পৃথিবীকেই ঘর ভেবে।
আজ থেকে প্রায় দু’দশক আগে ১৯৯৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল এক ফরাসি ছবি ‘লাচো ড্রম’। পরিচালনায় টনি গাটিফ। তিনি নিজও আসলে রোমা গোষ্ঠীরই উত্তরসূরি। সেই ছবিতে দেখা গিয়েছিল উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে স্পেন পর্যন্ত রোমানিদের ছড়িয়ে পড়ার কাহিনি। ছবির শুরুতেই ছিল ঊষর থর মরুভূমির দৃশ্য। ক্রমে ইজিপ্ট, রোমানিয়া, হাঙ্গারি, স্লোভাকিয়া, ফ্রান্স হয়ে তা শেষ হয় স্পেনে এসে। ছবিতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন সকলেই রোমা জনগোষ্ঠীর মানুষ। ২ ঘণ্টারও কম সময়ের এই ছবিতে ধরে রাখা আছে রোমাদের জীবনযাত্রার আশ্চর্য বৈচিত্রময় গাথা।
তবে শেষ পর্যন্ত শিকড়ের কাছে ফিরতে চাওয়ার বাসনা তো আর মিথ্যে হতে পারে না। রোমাদেরও হয়নি। তাই ভারত থেকে দূরে সরে থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়েও শেষ পর্যন্ত এদেশকে ভোলেনি তারা। ১৯৭৬ সালে চণ্ডীগড়ে আয়োজিত হয় প্রথম রোমা সম্মেলন। এরপর ১৯৮৩, ২০০১ সালের পর ২০১৬ সালেও ভারতের মাটিতে সম্মেলন করেছে রোমানিরা। তিনদিনের সেই সম্মেলনের সময় ‘ওয়ার্ল্ড রোমা অর্গানাইজেশন’-এর সভাপতি জোভান ডামনাজোভিচ দাবি করেন, তাঁরা যে আসলে ভারতেরই মানুষ তার নৃতাত্ত্বিক এবং শারীরবিদ্যাগত প্রমাণ রয়েছে। সুতরাং তাদের ভারতীয় সংখ্যালঘু হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই হবে এদেশের সরকারকে। এই দাবিই প্রমাণ করে দেয়, শিকড় যতই আলগা হয়ে যাক তা ছিন্ন হয়ে যায় না কখনও। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থেকেও ঘরে ফেরার অদম্য টান রোমানিদের রক্তের চোরাস্রোতে তাই মিশে রয়েছে।
দেখুন ভিডিও
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.