ছবি: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশ্বদীপ দে: লীলা মজুমদার বলেছিলেন, চার রকমের গল্প জমে ভাল। ভূত, বাঘ, প্রেম ও চোর। তিনি আলাদা করে ডাকাতের কথা উল্লেখ না করলেও ধরে নেওযা যেতেই পারে চোরেদের মধ্যেই হয়তো ডাকাতকেও অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছিলেন তিনি। কেননা জমজমাট ডাকাতের গল্প অনায়াসে জমিয়ে দিতে পারে যে কোনও বৈঠকি আড্ডা। সেখানে চোরের গল্প নেহাতই নিষ্প্রভ। ঝাঁকড়া চুল, মাথায় লাল ফেট্টি, কপালে ইয়া তিলক, রক্তজবার মতো চোখ- দল বেঁধে হা-রে-রে-রে করে গৃহস্থের বাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে যে ‘গ্ল্যামার’ অনেক বেশি সেকথা অস্বীকার করা যাবে না। রঘু ডাকাত বাংলার সেই ‘টিপিক্যাল’ ডাকাতদের এক চূড়ান্ত প্রতিনিধিস্থানীয়। আজও তাকে ঘিরে লোকায়ত কিংবদন্তির আবেদন নিশ্চয়ই যথেষ্ট, না হলে এই সময়ের এক শীর্ষস্থানীয় তারকা তাকে নিয়ে সিনেমা করার সিদ্ধান্ত নিতেন না।
টলিউড তারকা দেব (Dev) ছবি করছেন রঘু ডাকাতকে নিয়ে। সম্প্রতি কালীপুজোর দিন ছবির ফার্স্ট লুক শেয়ার করেছেন তিনি। আর তারপরই ফের নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে রঘু ডাকাতকে। একথা মানতেই হবে, আজকের দিনে মা-ঠাকুমা-দাদুদের কাছে শুয়ে শুয়ে গল্প শোনার দিন শেষ। তাই রঘু ডাকাতকে নিয়ে নতুন প্রজন্মের প্রশ্নের শেষ নেই। আর এই উত্তর গুগলও দিতে পারবে না। কারণ ইতিহাস যখন হাত ধরে কিংবদন্তির তখন রহস্যের যে কুয়াশা তৈরি হয় তার সন্ধান পাওয়া অত সহজ নয়। তবু ডুব দেওয়াই যায় আদ্যিকালের বঙ্গদেশের বুকে। খুঁজে দেখা যেতে পারে টুকরো টুকরো কাহিনি।
রুপোলি পর্দায় গব্বর সিং কিংবা বাস্তবের পৃথিবীতে চন্দন দস্যু বীরাপ্পানদের দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এদের থেকে চরিত্রে, স্বভাবে একেবারেই আলাদা রঘু ডাকাতরা। আজকের দিনে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মুখে রুমাল বাঁধা যে ডাকাতদের কথা খবরের কাগজের পাতায় ভেসে ওঠে সেই সমীকরণেও স্থান নেই সে যুগের ডাকাতদের। তারা এতটাই অনন্য।
‘বাংলার ডাকাত’ নামে দু’টি বই রয়েছে। খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সেই দুই অতি বিখ্যাত বইয়ের লেখক। দুই বই আলো করেই রয়েছে রঘু ডাকাত। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত রঘু ওরফে রোঘো ডাকাত সম্পর্কে লিখছেন, ”রঘু ডাকাতের নামে লোকে এক সময়ে ভয়ে ভয়ে দিন কাটাইত। রঘু ডাকাতের বাড়ি কোথায় ছিল, কেহ ঠিক করিয়া বলিতে পারিত না। কেহ বলিত নদীয়া জেলায়, কেহ বলিত হুগলী, কেহ বলিত চন্দননগর।… রঘুর এভাবে থাকিবার প্রধান কারণ ছিল ধরা পড়িবার ভয়।… গভর্নমেন্ট সে-সময়ে রঘু ডাকাতকে ধরিবার জন্য অনেক টাকা পুরস্কার ঘোষণা করিয়াছিলেন।”
একই কথা খগেন্দ্রনাথ মিত্রের কথাতেও। তবে সেই সঙ্গে তিনি এও লিখছেন, ”মুশকিল হচ্ছে যে, তার অস্তিত্ব সম্বন্ধেই অনেকে সন্দিহান। সে যদি ছিলই না, তবে তার নামে এমন গল্প তৈরি করল কে? গল্পগুলি তার তৈরি শৌর্য-বীর্য-বুদ্ধিমত্তা-বদানতো ও নৃশংসতার।”
এভাবেই সমসাময়িক সময়েই যেন এক মিথ হয়ে উঠেছিল রঘু। সে নাকি রণ পা চেপে বিশ-পঁচিশ মাইল দূরে দূরে দল বেঁধে ডাকাতি করে ফিরে আসত। হাতে থাকত একটা লম্বা লাঠি। তার দলের লোকেদের হাতে লাঠি ছাড়াও তরোয়াল, ঢাল, বল্লমের রকমারি জোগান।
ডাকাত বললেই অবধারিত ভাবে চলে আসে কালী আরাধনার কথা। রঘুও কালীপুজো করেই ডাকাতি করতে যেত। সে একা নয়, তার দলের সকলেই। এই সময়ের বুকে সেই গল্পকে ছুঁতে চাইলে একবার ঘুরে আসতে পারেন কাশীপুরের খগেন চ্যাটার্জি রোডের রঘু ডাকাতের কালী মন্দির থেকে। শোনা যায়, এই মন্দিরের চিত্তেশ্বরী সর্বমঙ্গলা কালী প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রঘু নিজে। আর ছিল চিঠি দিয়ে ডাকাতি করতে আসার ‘মস্তানি’। সেযুগের ডাকাতের গল্প বলতে বসলে যে সব বৈশিষ্ট্যের কথা ওঠে, তার সব ক’টাই আমরা পাব রঘুর মধ্যে। নৈহাটির দুর্গাচরণ চক্রবর্তী হোক কিংবা কদমগাছির শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়- দুঁদে দারোগাদের নাকানি চোবানি খাওয়াত সে বলে বলে।
কীরকম সেই গল্প? যেমন একবার একবার দুর্গাচরণ দারোগাকে চিঠি দিল রঘু। জানিয়ে দিল, ”শিগগিরি আপনার সঙ্গে দেখা করব। প্রস্তুত থাকবেন। ইতি সেবক রঘু।” চিঠি পেয়ে তো দারোগাবাবু উত্তেজিত। বিকেলবেলায় হঠাৎই তার সঙ্গে দেখা করে মাছ উপহার দিয়ে যায় এক ব্যক্তি। কে জানত সে ব্যাটাই রঘু! পরে আরেক চিঠিতে রঘু লিখে জানায়, ”দারোগাবাবু আমার কথা রেখেছি।” সেই সঙ্গে প্রশ্ন, ”মাছটা কেমন খেলেন?”
এমনই নায়কোচিত কেতা রঘুর। কিন্তু সে কি কেবলই এক নিষ্ঠুর দস্যু? একটা গল্পের উল্লেখ মেলে যা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় রঘু ছিল বঙ্গদেশের ‘রবিন হুড’। চূর্ণী নদীর তীরে এক ছোট্ট গ্রামে দরিদ্র ব্রাহ্মণকন্য়ার বিয়ের আসরে আচমকাই নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। বর ও বরযাত্রীরা ঘাটে এসে নৌকো বেঁধেও বিয়ের আসরে ঢুকতে নারাজ। আগে পণের সব টাকা মিটিয়ে দিতে হবে। তবে বিয়ে হবে। নাহলে এখান থেকেই ফিরে যাবে তারা। কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার কান্না শুনে সেখানে হাজির এক ঢ্যাঙা চেহারার লোক। কাঁধে লম্বা লাঠি। প্রবীণ মানুষটাকে কাঁদতে বারণ করে সে সটান গিয়ে হাজির বরযাত্রীদের সামনে। গিয়ে সোজা হুঙ্কার, এখনই বিয়ে না করতে গেলে নৌকাশুদ্ধু ডাঙায় তুলে হাজির করবে সে! বরপক্ষ তো অবাক। তাদের প্রশ্ন, কে তুমি? এত বড় আস্পর্ধা! ছোট্ট জবাব দীর্ঘকায় সেই আগন্তুকের, ”আমি রঘু ডাকাত।” ব্যাস! এরপর বিয়ে আটকায় কার সাধ্য? মেয়ের বাবার কাকুতি মিনতি সত্ত্বেও রঘু অবশ্য বেশিক্ষণ থাকেনি সেখানে। দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে যায় তার অপসৃয়মাণ চেহারা।
এই হল রঘু ডাকাতের গল্প। সময়ের গায়ে ক্রমেই পড়ে বিস্মৃতির প্রলেপ। কিন্তু জেগে থাকে গল্পেরা। কেননা তারা দীর্ঘজীবী হয়। এভাবেই সে যুগের কত সব ঐতিহাসিক তথ্য যে মুছে গিয়েছে। কিন্তু থেকে গিয়েছে এই সব গল্প। শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল রঘু ডাকাতের? যোগেন্দ্রনাথ লিখছেন, ”রঘু ডাকাতের পরিণাম কী হইয়াছিল জানি না। এ-বিষয়ে সরকারি কাগজপত্রে সন্ধান মিলে না। সে এমন জনপ্রিয় দস্যু ছিল যে গরিব-দুঃখীরা তাহার সন্ধান জানিলেও কেহই বলিয়া দিত না।”
জনপ্রিয় দস্যু। সেকালের পপ কালচারের অংশ হয়ে আজও রোঘো তথা রঘু ডাকাতরা দাপিয়ে বেড়ায় চিরকালের গল্পগাছায়। তাই রুপোলি পর্দাতে তার জীবন ফুটিয়ে তুলতে উদ্যোগী হন আজকের জনপ্রিয় নায়ক। পুলিশের খাতায় ভিলেন হয়েও এভাবেই কিংবদন্তির নায়ক হিসেবে পাকা স্থান পেয়ে যায় আদ্যিকালের এক ডাকাত সর্দার। সৌজন্যে তাকে ঘিরে জমে থাকা রহস্যঘন সব গল্পগাছা। আগেই বলেছি, গল্পেরা দীর্ঘজীবী হয়। টিকে থাকে বছরের পর বছর পেরিয়েও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.