বিশ্বদীপ দে: বহু শতাব্দী আগের এক অন্ধকার রাত। নিস্তব্ধতাকে চমকে দিয়ে খসখস করে কে যেন লিখে চলেছে এক বিরাট বই। সূর্য ওঠার আগেই সেটা শেষ করে ফেলতে হবে। কে সে? নাম অবশ্য শোনা যায় সাজাপ্রাপ্ত এক সন্ন্যাসীর। কিন্তু বহু মানুষই একমত। এ বই লেখা কোনও নশ্বর মানুষের কম্মো নয়। এ বই লিখেছে স্বয়ং শয়তান। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, বইয়ের ভিতরে লুসিফার নিজেই নাকি এঁকে গিয়েছে আত্মপ্রতিকৃতি! যা দেখলে আজও শিউরে ওঠে মানুষ। ইতিহাসের অনন্য বিস্ময় ‘কোডেক্স গিগাস’। নানা হাত ঘুরে আজ সুইডেনের (Sweden) জাতীয় লাইব্রেরিতে রয়েছে ৩১০ পাতার ‘ডেভিলস বাইবেল’ (Devil’s Bible) তথা ‘শয়তানের বাইবেল’।
মাত্র একরাত্রেই লিখে শেষ করা বোহেমিয়ার (Bohemia) অতিকায় সেই পাণ্ডুলিপি বয়ে নিয়ে যেতে অন্তত দু’জন মানুষ লাগে। তিন ফুটের বইটির ওজন ১৬৫ পাউন্ড তথা প্রায় ৭৫ কেজি! অর্থাৎ পৌনে কুইন্টাল। তবে সেই পাণ্ডুলিপি আজ আর যে কোনও মানুষের জন্য উন্মুক্ত নয়। প্রাচীনত্বের কারণে রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। আসলে ‘শয়তানের বাইবেল’ তো আজ লেখা হয়নি। লেখা হয়েছিল ত্রয়োদশ শতকের একেবারে শেষ দিকে ১২৯৫ সালে বোহেমিয়ার এক খ্রিস্টীয় মঠে। তারপর অনেক সময় পেরিয়ে গিয়েছে। পৃথিবী মধ্যযুগের অন্ধকার সময় পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে আলো ঝলমলে আধুনিক যুগের ভিতর। তবুও ‘কোডেক্স গিগাস’-এর রহস্য ভেদ হয়নি। বরং যত সময় এগিয়েছে ততই যেন রহস্যের রং পাকা হয়েছে।
কেমন সে রহস্য? সেকথা বলতে গেলে শুরু থেকে শুরু করতে হয়। যে সাজাপ্রাপ্ত সন্ন্যাসীর কথা শুরুতে বলা হয়েছে, তার কথায় আসা যাক। ‘হেরমান দ্য রিক্লুজ’। তাঁর নামই রয়েছে লেখক হিসেবে। কে তিনি? শোনা যায়, কোনও এক গর্হিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। আর তাই তাঁর ঠাঁই হয়েছিল অন্ধকার কুঠুরিতে। রাজা হুকুম দিয়েছিলেন জীবন্ত কবর দেওয়া হোক তাঁকে। সন্ত্রস্ত সন্ন্যাসী প্রাণভিক্ষা করেন রাজার কাছে। প্রস্তাব দেন, তিনি একরাতেই লিখে ফেলবেন এমন এক বই যেখানে থাকবে পৃথিবীর লুপ্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার।
তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান রাজা। প্রাণ বাঁচাতে লেখা শুরুও করেন হেরম্যান। কিন্তু রাত গড়াতে না গড়াতে তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, একাজ এক রাতের মধ্যে করার কোনও রকম সম্ভাবনা নেই। তাই তিনি উপায়ান্তর না দেখে দ্বারস্থ হন খোদ শয়তানের। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে নরক থেকে এসে হাজির হয় লুসিফার। সন্ন্যাসী নিজের আত্মা সঁপে দেন শয়তানকে। পরিবর্তে এক রাতের মধ্যে শয়তান লিখে ফেলে সেই অতিকায় পাণ্ডুলিপি। যার ২৯০তম পাতায় এঁকে দিয়ে যায় আত্মপ্রতিকৃতি।
এই হল কিংবদন্তি। কিন্তু স্রেফ কিংবদন্তি দিয়েই এত বড় রহস্যের আধার তৈরি সম্ভব ছিল না। কেননা প্রাচীন বহু পাণ্ডুলিপির গায়ে গায়ে এমন কৌতূহলপ্রদ কাহিনি জুড়ে থাকে। আসলে এই পাণ্ডুলিপিটি দেখে বোঝা যায়, এই কাজ সত্যিই একজনের পক্ষে করা অসম্ভব। অথচ খচিত লিপিবিন্যাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, তা একজনেরই হাতের লেখা। সুইডেনের এক হস্তলিপি বিশারদ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে এই রায় দিয়েছেন।
তাহলে? এক রাতে লেখার কথা যদি মিথ্যেও হয়, তাহলেও এমন অতিকায় এক পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ করতে পাঁচ বছর লেগে যাবে যদি কেউ সারা দিন সারা রাত ধরেও লিখে যায়। একটা হিসেব বলছে, দৈনিক ঘণ্টা তিনেক ধরে কাজ করলে লেগে যাবে ২৫ বছর! একথা ভাবতে বসলে ঘোর অবিশ্বাসীও থমকে যান। মধ্যযুগের এক রহস্যময় রাত ঘিরে লুসিফারের প্রত্যাবর্তনের মিথ ক্রমেই জেঁকে বসতে থাকে। তার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে যায় ‘শয়তানের বাইবেল’ তকমা। ক্রমশ জোরাল হয় মিথ, কোনও মানুষ নয়, এই বই লিখেছিল লুসিফার।
কী রয়েছে এই অতিকায় বইয়ে? চতুর্থ শতকে লেখা লাতিন বাইবেলের পুরোটাই রয়েছে তাতে। বইয়ের অর্ধেক অংশ জুড়ে রয়েছে সেই বাইবেল। এরই পাশাপাশি রয়েছে ফ্লেভিয়াস জোসেফাসের লেখা ইহুদি যুদ্ধ ও ইুহদি পুরাতত্ত্ব, সেন্ট ইসিডরের লেখা বিশ্বকোষ ও কসমাস নামের এক বোহেমিয়ান সন্ন্যাসীর লেখা ‘দ্য ক্রনিকলস অফ বোহেমিয়া’। এছাড়াও ভয়ংকর রোগ থেকে জাদুবলে মুক্তি, কালো জাদুর মতো অতিপ্রাকৃত নানা বিষয় ছড়িয়ে রয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায়। বাদ যায়নি ডাইনি চেনার কায়দাকানুন কিংবা চোর ধরার কৌশলও। কেবল ‘টেক্সট’ নয়, রয়েছে নানা ছবি। শয়তানের ছবির কথা তো আগেই বলা হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে স্বর্গ, পৃথিবী, পশুপাখির ছবিও। ব্যবহৃত হয়েছে নানা রকম রং।
কে প্রথম এই আশ্চর্য বইকে ‘শয়তানের বাইবেল’ আখ্যা দিয়েছিল তা জানা যায় না। তবে বারবার হাতফেরতা হয়ে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে শয়তানের এই হ্য়ান্ডনোট!
যদিও শুরুতে এটি ছিল বোহেমিয়ার সেই মঠেই। পরে আর্থিক দেনা মেটাতে পাণ্ডুলিপিটি বন্ধক রাখা হয় অন্য এক মঠে। ১৫৯৪ সালে হাঙ্গারির রাজা দ্বিতীয় রুডলফের হাতে আসে এটি। তিরিশ বছরের যুদ্ধের পরে প্রাগ শহরে ঢোকে সুইডেনের সেনাবাহিনী। যুদ্ধজয় মানেই তো লুঠপাটের অধিকার! ১৬৪৯ সালে তাই অন্য সব কিছুর মতোই পশুর চামড়া দিয়ে বাঁধানো এই অতিকায় পাণ্ডুলিপি তারা দখল করে। তখন অবশ্য বইয়ের রহস্য তাদের অজানাই ছিল। কিন্তু এটির অতিকায় চেহারাই দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল সেনার। এটা যে অতি বিশেষ কিছু, বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাদের। সেই থেকেই সুইডেনের জাতীয় লাইব্রেরিতে রয়েছে বইটি।
১৬৯৭ সালে সুইডেনের রাজার লাইব্রেরিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে যায়। সহজে দাহ্য বলে দাউদাউ পুড়ে যায় প্রায় গোটা লাইব্রেরিটাই। আগুনের ঝাপটায় নাকি জানলা দিয়ে বাইরে পড়ে যায় কোডেক্স গিগাস। এদিকে পরে দেখা যায়, বই থেকে বারোটি পাতা কে যেন খুলে নিয়েছে। কেন খুলেছে তা যেমন জানা যায়নি, তেমনই এই কীর্তি কার ছিল তাও রয়ে গিয়েছে অজানাই।
২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ৩৫৯ বছর পরে প্রাগে ফের ফিরে আসে ওই বই। তবে তা ২০০৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্তই। পরে আবার সেটি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সুইডেনে। তবে এত বছরের প্রাচীনতার মোকাবিলা করতে বইটি আর আমজনতার জন্য দ্রষ্টব্য নয়। কিন্তু গোটা বইটির ডিজিটাল সংস্করণই লাইব্রেরির ওয়েসবাইটে গেলে দেখা যাবে।
একেবারে শেষে এসে আরেকবার শয়তানের সেই ছবির প্রসঙ্গে ফেরা যাক। বলা হয়, মধ্যযুগে শয়তানের যে সব ছবি দেখা যায় তার থেকে অনেকটাই আলাদা এই ছবি। ১৯ ইঞ্চি দীর্ঘ এই ছবিতে শয়তান একেবারে একা। নিম্নাংশের একখণ্ড বস্ত্র ছাড়া বাকি শরীর নিরাবরণ। বলা হয় পরনের ওই বস্ত্র আসলে নিজেকে ‘অন্ধকারের রাজপুত্র’ হিসেবে দেখানোর জন্যই শোভা পাচ্ছে লুসিফারের শরীরে। দলবলবিহীন একলা শয়তানের এই ছবি ঘিরেই সবচেয়ে বেশি রহস্য। কেউ কেউ বলেন, সন্ন্যাসী নিজেই শয়তানকে তুষ্ট করতে এই ছবি এঁকেছিলেন। কিন্তু বাকিদের বিশ্বাস ছবিটি এঁকেছে খোদ শয়তানই। অন্ধকার এক রাতে খসখস করে পাণ্ডুলিপির শরীরে নিজের কলম বুলিয়ে। রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষেরা নতুন সহস্রাব্দের বুকে দাঁড়িয়েও কল্পনায় সেই অতিলৌকিক ছবি চাইলেই দেখতে পান চোখের সামনে। আর শিহরিত হন। তাদের কল্পনাকে অক্সিজেন দিতে খোদ শয়তানই উঁকি দেয় এই অভূতপূর্ব বইয়ের পাতার ভিতর থেকে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.