বিশ্বদীপ দে: ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান।’ জীবনের একেবারে শেষে রয়েছে এক নির্জন স্টেশন। জনহীন, কুয়াশাময় সেই স্টেশনে একাই নেমে যেতে হবে। এটাই ভবিতব্য। ইঙ্গমার বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ ছবিতে নাইট মৃত্যুকে দাবায় হারাতে চেয়েছিল। এই ইচ্ছে আসলে প্রতিটি মানুষেরই। সে জানে, এ এক অসম যুদ্ধ। তবু লড়াই তাকে দিতেই হবে। অথচ রবীন্দ্রনাথ, তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে ‘শ্যাম’ সম্বোধন করেছিলেন। তাহলে কখনও কি এমন পরিস্থিতি জন্ম নিতে পারে যখন মৃত্যুকেই পরম রমণীয়, একান্ত কাঙ্ক্ষিত বলে মনে হয়? চিকিৎসকরা বলছেন, নিতেই পারে। দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত কোনও মানুষ যখন অকথ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁর মনে হয় একমাত্র মৃত্যুই হয়তো তাঁর সব কষ্ট, সব বেদনাকে লাঘব করতে পারে। সে তখন চায় মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে। চায় স্ববধের অধিকার। পৃথিবীর কয়েকটি দেশে সেই অধিকারকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। যন্ত্রণাহীন সেই মৃত্যুপদ্ধতির নামই ইউথেনেশিয়া (Euthanasia)।
‘ইউথেনেশিয়া’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘ইউ’ এবং ‘থানাতোস’ থেকে এসেছে। ‘ইউ’ শব্দটির অর্থ সহজ এবং ‘থানাতোস’ কথাটির মানে মৃত্যু। অর্থাৎ ‘ইউথেনেশিয়া’ শব্দটির মানে দাঁড়াচ্ছে ‘সহজ মৃত্যু’। নেদারল্যান্ড, কানাডা, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ডে ইউথেনশিয়াকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কেবল মৃত্যুযন্ত্রণায় কষ্ট পাওয়া মানুষই নয়, যাঁরা কোমায় রয়েছেন বছরের পর বছর ধরে, তাঁদেরও মৃত্যুর জন্য আবেদন করেন তাঁদের স্বজনরা।
কিন্তু সত্যিই কি এই স্বেচ্ছামৃত্যু তথা নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অনুমতি প্রার্থনা ও তা মঞ্জুর করাটা নৈতিক? যতই হোক, সব সময় মৃত্যুমুখী ব্যক্তিই যে তা চাইছেন তা নয়। চাইছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পরিজন। আর তাঁদের হয়ে তা সম্পন্ন করছেন চিকিৎসকরা। ভাল করে খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যায়, এখানে প্রার্থনা করা হচ্ছে একজন নিরপরাধ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার আইনি বৈধতা। বিষয়টা নিতান্তই জটিল। নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের মতো বিষয় যেহেতু জড়িয়ে তাই স্বেচ্ছামৃত্যুর বহুমাত্রিকতাকে অস্বীকার করা যায় না।
এ আসলে এমন এক প্রশ্ন, যা যুগ যুগ ধরে ভাবিয়েছে মানুষকে। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বৈধ আত্মহত্যার প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। সেখানে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে, শারীরিক ক্লেদ ও অসুখের মারণ ছোবলে নীল হয়ে যেতে যেতেও নিজেকে শেষ করে দেওয়া যায় না। তা অন্যায়। মহাকাব্য থেকে সমসময়ে ফেরা যাক। একেবারে উলটো কথা বলছেন ফিলিপ নিৎসে। অস্ট্রেলিয়ার এই মানবতাবাদীই কয়েক কয়েক সপ্তাহ আগে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন একটি যন্ত্র বানিয়ে। যে যন্ত্রকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে সুইজারল্যান্ড। যন্ত্রটির সাহায্যে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া যাবে। ফলে প্রায় চোখের নিমেষেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন ব্যবহারকারী। ক্যাপসুল আকারের যন্ত্রটি দেখতে অনেকটা কফিনের মতো। যে সংস্থা এটি বানিয়েছে নিৎসে তারই প্রধান। বহুদিন ধরেই ইউথেনেশিয়ার স্বীকৃতি নিয়ে সরব তিনি। তাঁকে ডাকা হয় ‘ডক্টর ডেথ’ নামে।
ইউথেনেশিয়ার পক্ষে তাঁর বক্তব্য, ‘‘এর অর্থ আমরা চাইছি মানুষকে অসম্মান, ব্যথা ও পীড়া নিয়েও বেঁচে থাকতে হবে। অথচ আমরা আমাদের পোষ্যদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি দয়ালু হয়ে উঠতে পারি যখন তাদের যন্ত্রণা অকথ্য হয়ে ওঠে। এটা একেবারেই যুক্তিযুক্ত কিংবা পরিণতমনস্কতা হল না। সমস্যা হল, বহু শতাব্দী ধরে আমরা নানা ধর্মীয় ফাঁদে আটকা পড়ে রয়েছি।’’ সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, বহু বয়স্ক মরণাপন্ন মানুষ কিন্তু মনে করেন, বহু ক্ষেত্রেই ইউথেনেশিয়াই অনেক বেশি বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত। ‘ডক্টর ডেথে’র কথায়, ‘‘এই বরিষ্ঠ মানুষদের সঙ্গে কথা বললে অনেক বেশি অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।’’
কথা হচ্ছিল চিকিৎসক কুন্তল ঘোষের সঙ্গে। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের প্যালিয়েটিভ কেয়ার স্পেশালিস্ট। মারণরোগে যন্ত্রণাদীর্ণ রোগীর একেবারে শেষ পর্যায়ের চিকিৎসা করাই তাঁর কাজ। নিত্যদিন মরণাপন্ন মানুষকে তিলে তিলে ফুরিয়ে যেতে দেখেন। যাঁদের আর নিরাময়ের কোনও রকম সম্ভাবনাই অবশিষ্ট নেই। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম যখন ডাক্তার হিসেবে শপথ নিয়েছিলাম, তখন একরকম ব্যাপার ছিল যে মানুষকে বাঁচাতেই হবে। কিন্তু প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্য। দুরারোগ্য রোগীদের শেষ দিনগুলো যাতে স্বাভাবিক গতিতে তার অভিমুখে এগিয়ে যেতে পারে, সেটা দেখাই এখানে লক্ষ্য।’’ তিনি জানাচ্ছেন, এমন রোগী তিনি দেখেছেন, যাঁরা কাকুতি মিনতি করেছেন একেবারে অব্যাহতির জন্য, কেননা কষ্ট তখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে বহু দূরে। আবার, বহু ক্ষেত্রেই রোগীরা সেসব না বলে কেবল বারবার জানতে চান, আর কতদিন আয়ু বাকি রয়েছে। একই প্রশ্ন করেন রোগীর আত্মীয়রাও। সেই আকুতি থেকেই স্পষ্ট, আর যখন জীবনে ফেরার, যন্ত্রণার মরণ আলিঙ্গন থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও উপায়ই অবশিষ্ট নেই, তখন সব কিছু শেষ হওয়াই কাম্য।
কিন্তু ইউথেনেশিয়াকে স্বীকৃতি দেওয়ারও উলটো দিক রয়েছে। ডা. ঘোষের আশঙ্কা, ‘‘হয়তো একটা উদ্দেশ্য নিয়ে সেটা করা হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আশঙ্কা থাকেই, এই নিয়মকে কাজে লাগিয়ে হয়তো ক্রাইমও হতে পারে। সেদিকটাও খেয়াল রাখা দরকার।’’ তাঁর মতে, ইউরোপীয় সমাজে হয়তো এই নিষ্কৃতি-মৃত্যুর জন্য একটা জনমত গড়ে উঠেছে। ভারতীয় সমাজে এখনও পরিমাণটা খুবই কম। যদি সমাজের বৃহত্তর অংশ থেকে দাবি উঠে আসে, তাহলে হয়তো আইনি কোনও সিদ্ধান্তও নেওয়া হবে। আপাতত উত্তরটা ভবিষ্যতের হাতেই ছাড়ছেন তিনি।
প্রায় চার বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিল। শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল, যাঁরা মৃত্যুশয্যায় অব্যক্ত কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু তা মিলবে কঠোর নির্দেশিকার ভিত্তিতেই। অর্থাৎ এতদিনের স্থবির পরিস্থিতি এক লহমায় বদলে দিয়েছে। কিন্তু এখনও বহু পথ বাকি।
শেষ করা যাক অরুণা শানবাগের কথা দিয়ে। ১৯৭৩ সালে হাসপাতালের এক ওয়ার্ড বয়ের লালসার শিকার হন তরুণী এই নার্স। তাঁর গলায় চেপে ধরা হয়েছিল কুকুর বাঁধার চেন। সেই আঘাতে শেষ পর্যন্ত কোমাতে চলে যান তিনি। ওই অবস্থাতেই ছিলেন ৪২ বছর! ২০১৫ সালে অরুণার মৃত্যু হয়। সাংবাদিক ও সমাজকর্মী পিঙ্কি ভিরানি অরুণার নিষ্কৃতি-মৃত্যুর আরজি জানালেও হাসপাতালের ডাক্তার-নার্স-কর্মীদের বিরোধিতার পরে সুপ্রিম কোর্ট সেই আরজিকে নাকচ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেই মামলায় প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছিল। যা এক অন্য মোড়ে পৌঁছেছে ২০১৮ সালে। আগামিদিনে হয়তো ফের নতুন কোনও অধ্যায় অপেক্ষা করে রয়েছে। আসলে প্রশ্নটা সহজ নয়, উত্তরও এখনও অজানাই। সেজন্য অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া আপাতত উপায় নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.