অঙ্কন: অর্ঘ্য চৌধুরী।
বামুন সমাজের ঢিলে হালে মনখারাপ ব্রহ্মদত্যির! ডেকে ডেকেও সাড়া পাচ্ছে না বেচারা নিশি! বাকিদের অবস্থাও তথৈবচ। ভূত চতুর্দশীতে মনের কথা থুড়ি ‘আত্মাকথা’ জানালেন বাংলার ভূতেরা। আজ মেছোর পালা। ভূতের ভাষাকে মনুষ্য পাঠযোগ্য করলেন কিশোর ঘোষ।
ইঁলিশ ইঁলিশ ইঁলিশ
কাঁছেই যঁখন ছিঁলিস
দুঃখ কেঁন দিঁলিস!
নঁমস্কাঁর, আঁমি মেঁছো, মেঁছো ভূঁত। ‘আত্মাকথা’র শুরুতেই ভূত সাহিত্যের মেজর কবি ভয় গোস্বামীর সাম্প্রতিক কবিতা আউড়ে নিলাম। প্রশ্ন করতে পারেন-‘দিলিস’ আবার কেমন কথা? ‘দিলিস’ হল গিয়ে ‘দিলি’র কাব্যিক রূপ। যদিও মনখারাপ। দেয়নি ওরা। বাংলাদেশ এবারও বেজায় ভুগিয়েছে, সময় মতো ভারতে ইলিশ পাঠায়নি। লোকে একবার স্বাধীনতা পেলেই ভেবলে যায়, কাপড়ে-চোপড়ে অবস্থা হয়, সেখানে ওরা পেয়েছে দুবার। মাথার ঠিক থাকার কথা নয়। থাকেওনি। কেমিক্যাল লোচা হয়ে গিয়েছে। ইলিশের মধ্যেও ভারতের ‘ভূত’ দেখেছে ব্যাটারা। যেমন বন্যায়, ক্রিকেটে, হাসিনায় দেখে!
তবে এভাবে ‘ভূত’ শব্দের ব্যবহারে তেনাদের মানে আমাদের অমিতাভ বচ্চন টাইপ ঢ্যাঙা আপত্তি আছে। বিশেষত আমরা, মেছোরা ভূত সমাজে রীতিমতো মান্যিগন্যি.. বুঝলেন। এক ব্রাহ্মণ মরা ভূত ব্রহ্মদত্যি ছাড়া কাউকে রেয়াত করি না। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা হলাম গিয়ে খাঁটি বাঙালি ভূত। ‘মৎস্য জ্ঞান, মৎস্য প্রাণ, মৎস্য চিন্তামণি।’ সাধারণত পুকুরপাড়ে বা জলাশয়ের ধারে, যেখানে বেশি মাছ পাওয়া যায়, ভুরভুর করছে মন কেমন করা আঁশটে গন্ধ,,, সেখানেই ঘাঁটি গাড়ি। মাঝে মাঝে গেরস্থের রান্নাঘর, জেলেদের নৌকা থেকেও মাছ চুরি করে খাই বটে। স্টেশন বাজার থেকে কেউ মাছ কিনে গাঁয়ের নির্জন রাস্তা দিয়ে ফিরলে তার পিছু নিই। নির্জন বাঁশঝাড়ে বা বিলের ধারে ভয় দেখিয়ে মাছ ছিনিয়ে নিই। তবে কিনা ‘মানুষ ভালো, থুড়ি ভালো ভূত আমরা। মানুষের ক্ষতি করি না কক্খনও।
কী ছাই বলছি, মানুষের ক্ষতি করে সাধ্য কই আজকের ভূত সমাজের। আগের সুখের দিন কি আর আছে! সে এক দিন ছিল বটে… থম মারা সন্ধ্যায় তাল গাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে একানড়ে। জ্যোৎস্না রাতে বাবলা গাছে ঝুলতে ঝুলতে চুল শোকাত সেক্সি-সুন্দরী পেত্নী। আসল কথা যবে থেকে গ্রামবাংলায় ঘনঘন লোডশেডিং নেই, অলিতে গলিতে হ্যালোজেন হাই ভোল্টেজ অত্যাচার চালাচ্ছে, রাতের মাঠঘাটও ফকফকা আলোয়, তবে থেকেই মেছো হোক বা গেছো, ভূতেদের কপাল পুড়েছে মশাই! দুমুঠো অন্ধকারের জন্য এখন মাইল মাইল পাড়ি দিতে হয় আমাদের। আচ্ছা বলুন তো, অন্ধকার কী খুব খারাপ?
অন্ধকার তো আলোর আয়না। কেবল রঙটাই যা আলাদা। আমি মেছো ভূত, আপনারা হয়তো আমার কথায় তেমন আমল দেবেন না, সে না দেবেন না। তবু বলব, এটা অতি আলোর যুগ। ডিজে বাজিয়ে নাচতে নাচতে মহাকাশে পর্যন্ত লেজার লাইটের থুতু ছেটাচ্ছে মানুষ। আমার ধরুণ গে নয় কুড়ি মানে একশো আশি বছরের ভূত জীবন। কম তো দেখিনি। সেই নবাবের শাসনের শেষ থেকে ইংরেজ আমল, বিশ্বযুদ্ধ থেকে কদিন আগের মহামারী কোভিড। সেকালে কিন্তু আলো আর অন্ধকারের মধ্যে একটা ভারসাম্য ছিল। বন্ধুত্বও বলতে পারেন। আজ থেকে বছর পঞ্চাশ আগে জ্যোৎস্নারাতে বাঁশঝাড়ের সৌন্দর্য দেখে মানুষ জন্মের প্রেমিকার মুখ মনে পড়ত আমার। তেমন তেমন নক্ষত্রের রাতে বেড়াল সেজে গৃহস্থের রান্নাঘর থেকে মাছ চুরি করে ফিরছি, তেপান্তরের মাঠে আকাশ ভরা তারা দেখে মনটা কেমন ইয়ে হয়ে যেত! অমনি ভয় গোস্বামীর সেই কবিতা আউড়াতাম–“আকাশ ভরা তারা/ঘুমায় গোটা পাড়া/ অন্ধকারের জয় মানে তো/ আলোর কাছে হারা।” যদিও মিথ্যে আলোর জ্বালায় সেই অন্ধকারেরও মৃত্যু হয়েছে কবেই।
সব মিলিয়ে সোজা কথাটা হল- ভূতেরা ভালো নেই। মেছোরা আরও বেশি রকমের মন্দ দিন কাটাচ্ছে। যেহেতু পুকুর বুজিয়ে ফ্ল্যাট তুলছে প্রোমোটারের দল। পুকুর-ডোবা-খাল-বিল না থাকলে মেছো ভূত কোথায় থাকবে? কী খাবে? মনে রাখবেন, এই প্রোমোটাররা কেবল মানুষের না, ভূতেদেরও চরম শত্তুর। ওদের জন্যই শহর ও শহরতলিতে পোড়ো বাড়ি নেই বললেই চলে। কেউ ভালো নেই- আহা ভূত, বাহা ভূত/ কিবা ভূত, কিম্ভূত/ বাবা ভূত, ছানা ভূত/ খোঁড়া ভূত, কানা ভূত/ কাঁচা ভূত, পাকা ভূত/ সোজা ভূত, বাঁকা ভূত/ রোগা ভূত, মোটা ভূত/ আধা ভূত, গোটা ভূত… সক্কলেরই বড্ড মন খারাপ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে মাইরি। এবার বিক্ষোভে নামব, মিছিল করব, অনশনেও বসতে পারি আমরা। সবার মতোই আমাদেরও তো বিচার চাই। “উই ওয়ান্ট জাস্টিস।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.