গাছের অভাবে বিপন্ন গেছো! ডেকে ডেকেও সাড়া পাচ্ছে না বেচারা নিশি! বাকিদের অবস্থাও তথৈবচ। ভূত চতুর্দশীতে মনের কথা থুড়ি ‘আত্মাকথা’ জানালেন বাংলার ভূতেরা। আজ ব্রহ্মদত্যির পালা। ভূতের ভাষাকে মনুষ্য পাঠযোগ্য করলেন কিশোর ঘোষ।
ওং ক্রিং চু কিত কিত অন্ধকারয় নমঃ
পৈতে ছাড়া কৈতে কথা বাঁধে
ওং ক্রিং চু কিত কিত অন্ধকারয় নমঃ
তেঁতুল গাছে পেত্নি কেন কাঁদে
বুঝলেন কিনা… তন্তরমন্তর ছাড়া আমার ‘আত্মাকথা’ শুরুই হবে না। কথা হচ্ছে, মানুষের সমাজই তো মরে ভূত হয়, ফলে ‘আমরা’ও আছি। ভূত সমাজের মাথার উপরে দণ্ডায়মান। এখন অবশ্যি একটা বেল গাছে চড়ে বসেছি। মনের সুখে পৈতে দিয়ে পিঠ চুলকে তারা গুনছি। উদ্দেশ্য হল, ভুল ধরা। ছোড়া একানড়ে খুব করে ধরেছে—“কুষ্ঠিটা চেক করে দিন না স্যর, কোন গাছে চাপলে দিনটা ভালো যাবে… গাছে ঝুলে কতবার পা দোলালে শাঁকচুন্নীর সঙ্গে দেখা হবে?” রাত সানি লিওনির মতো গভীর হলেই একানড়ে হাজির হবে। তখন কিছু একটা ভুজুংভাজুং দিতে হবে। এরা (ভূত সমাজের সাধারণ নাগরিকরা) এগুলো পছন্দ করে, মজা পায়। ভুড়িওলা ছকবাজ ব্রাহ্মণ থুড়ি ব্রহ্মদত্যি কিছু বলবে, বাকিরা সেইটাকে মান্য করবে। আসলে মানুষ জন্মের বদভ্যাস! পাথর-আংটি-তাবিজ-কবচ আঙুল, গলায়, কোমড়ে বাঁধলে নাকি জীবন বদলে যাবে! এত সহজ?
ব্রহ্ম্যদত্যি হওয়া অবশ্যি সোজা ব্যাপার না। আপনারা তো মানুষ, বেদ-উপনিষদ-গীতার কথা জানেন। বলুন… ওসব কারা লিখেছেন? ‘পহুছা হুয়া’ ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষিরাই তো। ওই ঋষিদের কী জাত ছিল? নিঘ্ঘাত ব্রাহ্মণ। অর্থাৎ, আমরা হলাম গিয়ে সেই জিনিস যাকে পাকড়াতে বিলের মতো মহাপ্রাণ পর্যন্ত ক্ষেপে উঠেছিল। চিনলেন কিনা বিলেকে? না চিনলে ধরিয়ে দিই—ছোটবেলার বিলে বড় হয়ে শিকাগো ঘুরে স্বামী বিবেকানন্দ। গাছে উঠে বসেছিল রাতভর। ব্রহ্মদত্যি নেই প্রমাণ করতে। আমরাও জ্ঞানি জিনিস, বিলে গাছে উঠতেই টপ করে অদৃশ্য হলাম! নামতেই ভূত-শরীর ধরলাম। এইখানে একটা জরুরি কথা বলতেই হয়। কোন কথা?
ব্রাহ্মণ ও বিবেকানন্দের দন্দ্বমূলক বাস্তবতার কথা। মানুষ জন্মে তো জেনেছেন ব্রাহ্মণ মানেই মুখো-বন্দ্যো-চক্কো-ভট্টো ইত্যাদি। তবে যে নরেন ‘দত্ত’কে গুরু পরমেশ্বর শ্রী শ্রী ভগবান মানলেন! তিনি কি ব্রাহ্মণের চেয়ে কিছু কম! আমি ব্রহ্মদত্যি, যখন মানুষ ছিলাম তখন বোকার হদ্দ সমাজকে কম ঘোল খাওয়াইনি, ভণ্ডামির ছোটখাটো ঢিপি ছিলাম মাইরি। ভূতজন্মে পুরো পালটি খেয়ে গেছি। তাই আমিই বলতে পারি—নরেন থেকে বিবেকাননন্দ হওয়াই ব্রাহ্মণত্ব। বেম্মো হওয়ার আর কোনও পথ-ঘাট-জেটি-ফেরি নেই। এইখানে বেদ পড়া একপিস জ্ঞান ঝারা যাক… বেদের বক্তব্য হল, ব্রহ্মজ্ঞানহীন ব্রাহ্মণের সন্তান ‘ব্রাহ্মণ’ নয় মোটেই, তিনি ‘ব্রহ্মবান্ধব’। কীরম সত্যি বলছি, কীরম ভালো হয়ে গেছি দেখছেন! ভূত সাহিত্যে আমাদের পরিচয়ে কিছু ভুল নেই তবে।
ব্রাহ্মণ ভূত ওরফে ব্রহ্মদৈত্য ওরফে ব্রহ্মদত্যি সম্পর্কে বলা হয়েছে—একদা বাঙালি ব্রাহ্মণ সন্তান এই ভূতেদের পরনে থাকে ধুতি, পৈতে। সাধারণত এরা আশ্রয় নিয়ে থাকে বেল গাছে। কথিত আছে, এই ভূত নাকি খুব দয়ালু। মানুষের উপকার করে। উপকারি ভূতের কথা উঠলে এঁদের নাম আসবেই। ভাবুন… ব্রাহ্মণ আবার উপকারি! জানি অব্রাহ্মণদের একাংশ বেজায় নাক সিঁটকোবেন। যদিও এটাই হল ভূত জীবনের মজা, মানব সমাজের আয়না, এক্কেবারে উলটো কেস। ভূতেরা জাতপাত মানে না। ফলে দলিত, নিচু জাতের উপর অত্যাচার নেই, মন্দির-মসজিদ-গির্জা নেই, দাঙ্গা-যুদ্ধ-মৃত্যু-রক্ত নেই। প্রমাণ হবে চতুর্দশীর রাতে, ভূশণ্ডীর মাঠে। সবাই জানে, এই রাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটারদের মতো গ্ল্যামারাস অন্ধকার নামে পৃথিবীতে। সেদিনই পিকনিক করবে ভূত সমাজ। মেনু কিন্তু সিম্পল–খাসির ভূতের মাংস আর ভাত, শেষপাতে গোভূতের দূধে তৈরি রসগোল্লা আর দই। পাত পেড়ে খাবো আমরা—একানড়ে, স্কন্ধকাটা, গেছো, মেছো, মামদো, শাঁকচুন্নী, পেত্নি… সক্কলে। তবে কিনা ব্রাহ্মণ বলে কথা, খেতে খেতেই খানিক মন্ত্র আওড়ে নেব—
ওং ক্রিং চু কিত কিত অন্ধকারয় নমঃ
পৈতে ছাড়া কৈতে কথা বাঁধে
ওং ক্রিং চু কিত কিত অন্ধকারয় নমঃ
তেঁতুল গাছে পেত্নি কেন কাঁদে
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.