জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। চারিদিকে বহুতলের রমরমা। তার উপর নগরায়ণের ধাক্কা। কৃষি জমি হারাচ্ছে। পুকুর, ডোবা সব হারিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির উঠোনে ছোট্ট সবজি বাগান তৈরির কথা শহুরে জীবনে কল্পনাই করা যায় না। তবে এক টুকরো জমি না থাকলেও বহুতলের ব্যালকনিতেই করা যায় জমিহীন চাষাবাদ। এখানে চাষ করতে জমি, লাঙল, বলদ, ট্রাক্টর কিছুই লাগে না। বারান্দায় টবেই চাষবাস হবে। ফলানো যাবে টাটকা শাকসবজি। বিষমুক্তও হবে। নিজে খেয়ে, অন্যকে খাইয়েও তৃপ্তি মিলবে। লিখেছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অন্তরা মহাপাত্র ও বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন বরিষ্ঠ গবেষক ড. পরিতোষ বিশ্বাস।
ভারতবর্ষে ২০২২ সালে লোকসংখা ছিল ১৪১-৭২ কোটি। ৫০৮৩ কোটি মানুষের পৌর এলাকায় বাস। ২০২১ সালের লোক সংখা ৪৮.৮১ কোটি। এক বছরেই লোক সংখা বেড়েছে ২.০২ কোটি। প্রতি বছর সংখা বেড়েই চলেছে। গ্রাম থেকে লোক স্থায়ীভাবে আসার ফলে, শহর বা শহরতলীর জন সংখা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চারিদিকে বহুতলের অগুন্তি ফ্লাট বাড়িতে ছেয়ে গেছে। চাষের জমি, বাগান, ডোবা, পুকুর সব হারিয়ে যাচ্ছে। এই এলাকায় টাটকা শাক, সবজির অভাব। এটি অভাব দূর করতে ফ্লাট বাড়ির ব্যালকনিতে চাষবাস হওয়া একান্তই দরকার। এখানে চাষ করতে জমি, লাঙল, বলদ, ট্রাক্টর কিছুই লাগে না। বারান্দায় টবেই চাষবাস হবে।
উনিশ শতকে মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলন শহরে, রাজা দ্বিতীয় নেবুচাঁদনেজার (৬০৫- ৫৬২ বিসি) তাঁর প্রিয় রানি অ্যামাইটিসের মনোরঞ্জনের জন্য ঝুলন্ত বাগান তৈরি করেন। বর্তমানে ইরাক দেশের ব্যাবিন প্রদেশের ইউফ্রেটিস্ নদীর তীরে, হিলাই গ্রামে যা রয়েছে। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি।
ব্যালকনিতে চাষবাস একান্তই দরকার। কারণ, শহর বা শহরতলিতে লোকসংখা অতিরিক্ত বৃদ্ধিতে চাষের জমি, বাগান, ক্ষেত সব হারিয়ে গেছে। ফলে, টাটকা শাক-সবজিতে টান পড়েছে। ব্যালকনিতে চাষ হলে এই সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে।
ফসল নির্বাচন ঋতু অনুসারে করতে হবে। লতাজাতীয় সবজি হলে ভাল হয়, যথা- উচ্ছে, কুমড়ো, লাউ, মটরশুঁটি, প্রভৃতি। এই সড গাছ আঁকশির সাহায্যে বারান্দার গ্রীলের রেলিং, টাঙানো দড়ি বা তার বেয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে ফল দেয়। টবে টম্যাটো, ধনে পাতা, লঙ্কা, গাজর, বীট, মূলো, সীম, বেগুন, পেয়ারা, কামরাঙা প্রভৃতি ফলানো যায়। ঝুলন্ত ব্যাগে মাশরুম আদার চাষ হয়।
তবে আপনার ব্যালকনি কোনদিকে?
এটি গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণমুখী ব্যালকনি এক নম্বর পছন্দ, এই দিকে সূর্যের আলো দীর্ঘক্ষণ থাকে। পূর্ব দিক দ্বিতীয় পছন্দ। তৃতীয় পছন্দ পশ্চিমদিক। টব বড় হলে, মাটির পরিমাণ বাড়ে। গাছও বেশি খাবার পায়। একটি টবে, একটি গাছ হলে, ফলন বেশি হয়। টব রঙীন, নকশাদার হলে, দেখতে আকর্ষণীয় হয়। ফ্ল্যাটের সৌন্দর্য বাড়ে। টবে গাছ লাগাতে হলে, টবের তলদেশে একটি ছোট ফুটো রাখতে হবে, অতিরিক্ত জল নিকাশির জন্য। ছোট চায়ের ভাঁড়ের টুকরো দিয়ে ওই গর্ত ঢেকে প্রথমে শুকনো পাতা, তার পর মাটি দিয়ে টব ভরতে হবে টবের মাটি হবে, ঝুরঝুরে এঁটেলো বেলে দোঁয়াশ। গুঁড়ো এই মাটির সাথে পরিমাণ মতো পচানো গোবর সার, কম্পোস্ট সার, পচানো সরিষার খইল, সুপার ফসফেট, পটাশ, হাড়ের গুঁড়ো, অনুখাদ্য মিশিয়ে পরিমাণ মতো টবের মাটিতে দেওয়া হয়।
টবের মাটিতে বীজ বা চারা লাগাবার পর প্রয়োজন মতো জল ছিটিয়ে দিতে হবে। রাত্রিতে বা বিকালে জল না দেওয়াই ভালো। কম্পোষ্ট সার তৈরি করতে হলে একটি পলিথিনের বড় গামলার আয়তনের ১০ শতাংশের সমান অংশের ঝুরঝুরে এঁটেলো বেলে দোঁয়াশ মাটি, ওই গামলার তলদেশে রাখতে হবে। তার উপর রান্নাঘরের প্রতিদিনের বর্জ্য পদার্থ, সবজির খোসা, ফলের খোসা, ভাতের ফ্যান, মাছের আঁশ, ব্যবহৃত চায়ের পাতা, প্রভৃতি ফেলতে হবে। এই আবর্জনার ভিতর ৫-৬টি বড় জাতের “ভড়ো” কেঁচো ছেড়ে দিয়ে, অল্প জল ছিটিয়ে কালো পলিথিনের চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে হয়, যাতে দুর্গন্ধ না ছড়ায়। ৩-৪ মাসের ভিতর বাদামী কালো কম্পোস্ট সার তৈরি হয়ে যাবে।
উপকারিতা
১) অর্থনৈতিক: ঘরে বসেই রাসায়নিক কেমিক্যাল বর্জিত টাটকা শাক, সবজি, ফল পাওয়া যায়। বিনামূলেই। কষ্টে করে বাজারে যেতে হয় না। ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বাড়ে।
২) পরিবেশ: ফ্ল্যাটের বায়ু দূষণ, গরম কমে যায়। এখানে পাখিও আসতে পারে। দূষণ মুক্ত পরিবেশে আপনি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাঁচতে পারবেন।
৩) মানসিক স্বাস্থ্য: প্রতিদিন সকালে এক ঘণ্টা গাছের সত্ন করলে রক্তচাপ, সুগার, টেনসান কমে যায়। মানসিক শান্তি বাড়ে, স্বাস্থ্য ভাল হয়। আয়ও বাড়ে।
৪) চাষের জমির অভাব: ব্যালকনিতে চাষ করলে, চাষের জমির অভাব অনেকটাই ঘুচবে।
৫) ব্যালকনি চাষের প্রচার: পৃথিবীর বড় বড় শহরে ব্যালকনি চাষের প্রসার ব্যাপক হারে বাড়ছে।
৬) নিজের খাবার নিজে ফলাও: নিজে ফলিয়ে অপরকে দিয়ে, নিজে খেলে অপার শান্তি পাওয়া যায়। সম্মানও বাড়ে।
৭) জিরো ফার্মিং: ব্যালকনি চাষ, জমিহীন চাষ। এই চাষ করলে সবাই উপকৃত হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.