বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: ঠিক যেন আগুনে ঝলসেছে পাতা। বিঘার পর বিঘা চা বাগান (Tea Garden) শ্যামলিমা হারিয়ে বাদামি হয়েছে। ক্রমশ তাপমাত্রার পারদ চড়তে এমনই বিপর্যয় ঘনিয়েছে চা বলয়ে। মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা (Temparature) সইতে পারছে না গাছ। সেচের ব্যবস্থা করেও তেমন লাভ হচ্ছে না। অনেক জায়গায় সেচের জলেও টান ধরেছে। ঝলসে ঝিমিয়ে পড়ছে পাতা। আবহাওয়ার এমন খামখেয়ালিতে একে রেড স্পাইডার, লুপারের মতো সবুজখেকো পোকার আক্রমণে চা পাতার গুণগত মান খারাপ হয়েছে। তার উপর দাম তলানিতে। এতটাই দাম নেমেছে যে উৎপাদন খরচ উঠছে না। এই পরিস্থিতিতে দিশেহারা উত্তরের ৫০ হাজার চা চাষির। লোকসানের ধাক্কায় অনেকেই চা বাগান তুলে দেওয়ার কথা ভাবছেন!
চা চাষিরা জানাচ্ছেন, অতি গরমে মার্চ-এপ্রিলে ফার্স্ট ফ্ল্যাশে (First flash) চা পাতার বেশিরভাগ ঝলসে নষ্ট হয়েছে। যতটুকু টিকে ছিল রেড স্পাইডার, লুপারের মতো সবুজ খেকো পোকা সাবার করেছে। খরা কাটিয়ে বৃষ্টি নামতে আশা ছিল সেকেন্ড ফ্ল্যাশে ঘাটতি পুষিয়ে যাবে। কিন্তু শিলাবৃষ্টি সেই আশার গুড়ে বালি ঢেলেছে। এরপর হঠাৎ বৃষ্টিতে টান ধরায় যতটুকু পাতা টিকে আছে, তার বেশিরভাগের গুণগত মান খারাপ। ভাল মানের যে পাতা উঠছে, সেটারও দাম মিলছে না। কেজি প্রতি কাঁচা চা পাতার দাম ঘুরপাক খাচ্ছে ১৫ টাকা থেকে ১৮ টাকার মধ্যে। অথচ এক কেজি কাচা চা পাতার উৎপাদন খরচ দাঁড়িয়েছে ২২ টাকা থেকে ২০ টাকা।
চাষিদের বক্তব্য, গত বছর মে মাসে সেকেন্ড ফ্ল্যাশের (Second flash)কাঁচা পাতার কেজি প্রতি দাম মিলছে ৩৫ টাকা থেকে ৩২ টাকা। কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্মল টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তী বলেন, “একে পাতার উৎপাদন অর্ধেকেরও কম। তার উপর দাম নেই। লোকসানের বহর ক্রমশ বেড়েই চলেছে। চাষিরা কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। অনেকেই গাছ তুলে ফেলার কথা ভাবছেন।”
শুধু সমতলের ছোট চা বাগান নয়। একই পরিস্থিতি দার্জিলিং (Darjeeling) পাহাড়ের বড় চা বাগানগুলিরও। টি অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গিয়েছে, দার্জিলিং পাহাড়ে ৮৬টি চা বাগান রয়েছে। ২০২১ সালে ওই বাগানগুলোর কাঁচা পাতা থেকে ৭.০১ মিলিয়ন কেজি চা তৈরি হয়েছে। ২০২২ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ৬.৬০ মিলিয়ন কেজি। এবছর উৎপাদন কোথায় দাঁড়াবে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। চা বাগান মালিক সঞ্জয় মিত্রুকা বলেন, “আবহাওয়ার জন্য পাতার মান খুবই খারাপ। এক হাজার টাকা কেজি দরেও তৈরি দার্জিলিং চা বিক্রি হচ্ছে না।” তিনি জানান, কয়েকদিনের মাঝারি বৃষ্টির জন্য এই যাত্রায় চা বাগানগুলো টিকেছে। কিন্তু লাভ কী? সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় যতটা সর্বনাশ হওয়ার হয়েছে। টি রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গিয়েছে, উত্তরের চা বলয়ে প্রতি বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হলেও এবার ছিল না। ‘ইন্ডিয়ান প্ল্যানটার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর চেয়ারম্যান মহিন্দ্রা বনসল জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে দাঁড়িয়ে পাহাড়-সমতলের চা শিল্প। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কী হবে, কেউ বুঝতে পারছে না।
কিন্তু কেন চা পাতার দাম উঠছে না? চা উৎপাদক সংস্থাগুলোর দাবি, তৈরি চায়ের বিক্রি নেই। ওই কারণে পাতার চাহিদা কমে যাওয়ায় দাম নেমেছে। নর্থবেঙ্গল টি প্রডিউসার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের’ প্রাক্তন সভাপতি সতীশ মিত্রুকা জানান, উত্তরে ২১০টি বটলিফ কারখানা রয়েছে। একটি বটলিফ কারখানা সচল রাখতে দৈনিক প্রয়োজন ৩০ হাজার কেজি কাঁচা চা পাতা। এখন মিলছে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার কেজি। সেটারও বেশিরভাগ গুণমানে এতটাই খারাপ যে চা তৈরি সম্ভব হচ্ছে না।
সতীশবাবু বলেন, “একে পর্যাপ্ত চা পাতা মিলছে না। তার উপর যে পাতা আসছে বেশিরভাগ ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। এদিকে যতটা চা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে তার ২০ শতাংশ বিক্রি হচ্ছে না। তাই কাচা পাতার দাম বাড়ছে না।” ওই পরিস্থিতিতে উত্তরের ৫০ হাজার চা চাষি বিপাকে পড়েছেন। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর জেলা এবং শিলিগুড়ি মহকুমায় চা বাগানগুলি রয়েছে। সেখান থেকে বছরে গড়ে ১২৫০ মিলিয়ন কেজি কাঁচা চা পাতা উৎপাদন হয়। ওই সমস্ত বাগানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। চা পাতার দাম তলানিতে চলে যাওয়ায় তাদেরও একাংশের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.