আমলকী মাইনর ফ্রুট ক্রপের মধ্যে পড়লেও রোগ-ব্যধি দূরীকরণে ও চাষযোগ্য ফল হিসাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন গুণের কারণে বাজারে বিপুল চাহিদা। চাষের খরচ কম। অনাবাদী জমি বা শুষ্ক আবহাওয়া পূর্ণ অঞ্চলেও এই চাষের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনে বাদামি দাগমুক্ত ভাল সাইজের আমলকীর উচ্চফলন খুব সহজেই পাওয়া যায়। যা বিক্রির পর ভাল আয়ের সুযোগ রয়েছে। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক সৌষ্ঠব দত্ত এবং তন্ময় মণ্ডল।
আম, কলা, পেয়ারা, আঙুর – এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ফল চাষের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফলন বাড়ানোর গবেষণা সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। উপরোক্ত ফলগুলি ছাড়াও আরও কিছু ফল গাছ আছে যারা মাইনর ফ্রুট ক্রপের মধ্যে পড়ে। কিন্তু সেই সমস্ত ফলগুলির গুণাগুণ পর্যালোচনা করে দেখার পর বৈজ্ঞানিকরা এই ফলগুলির নিত্য নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিশা দেখেছেন তাতে এই সব মাইনর ফ্রুট ক্রপগুলির (Minor Fruit Crop)গুরুত্ব বর্তমান কৃষিজগতের আঙিনায় অনেকটা বেড়েছে।
বর্তমান সময়ে আমলকীর চাহিদা: আমলকী (যাকে অনেকে আমলা বলেও চেনেন) হল এমন একটা ফল যা একবিংশ শতাব্দীতে মাইনর ফ্রুট ক্রপের মধ্যে পড়লেও রোগব্যাধি দূরীকরণে ও চাষযোগ্য ফল হিসাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান অধিকারে সক্ষম। প্রতিদিনের বাজার থেকে শুরু করে প্যাসেঞ্জার ট্রেনেও পর্যন্ত কমপক্ষে একজন করে আমলকী বিক্রেতার সন্ধান মেলে। উপযুক্ত পরিমাণে ভিটামিন-সি (Vitamin C) থাকার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের পেটের সমস্যার সমাধানে এর ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে সুস্বাদু ফলের সমান্তরালে নিজেকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যেতে এর সেরকম কোনও অসুবিধাই হয়নি।
আমলকী চাষে আকৃষ্টতা: শুধুমাত্র বাজারের বিপুল চাহিদার ভিত্তিতে বর্তমান যুগে চাষিদের মধ্যে আমলকী চাষের প্রবণতা যেমন অনেকটা বেড়েছে তার সঙ্গে সঙ্গে স্বল্প খরচে চাষ এবং মাটি জলবায়ু নির্বিশেষে চাষ করতে পারার যে আমূল সুবিধা আমলকী চাষে রয়েছে, তা অনেকটাই চাষিদের এই চাষের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলেছে। বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে অনেক কৃষক অন্যান্য ফল চাষের পাশাপাশি আমলকী চাষ ও ভালমতো শুরু করেছেন। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় দেখা গেছে যে চাষ অযোগ্য জমি বা শুষ্ক আবহাওয়া পূর্ণ অঞ্চলেও এই চাষের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ আমলকী গাছ খুবই শক্ত প্রকৃতির এবং যে কোনও রকম পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম। একটু সঠিক পদ্ধতি অবলম্বনে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একজন গরিব চাষিও আমলকী চাষ করে অনেকটা লাভের মুখ দেখতে পারবেন।
জৈবসার ভিত্তিক চাষের প্রবণতা: বহুদিন ধরে যথেচ্ছ পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে করতে আমরা কখন যে নিজেদের অজান্তেই মাটির উর্বরতা অনেকটা কমিয়ে এনেছি তা ধারণার অতীত। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার (Organic fertilizer) ব্যবহারে মাটির ভৌতিক ও জৈবিক গুণাবলির অপচয় ঘটে। তাই তো যে কেঁচোকে ‘চাষির বন্ধু’ বলা হত মাটিতে সেই কেঁচোর শনাক্তকরণ আজ দুর্লভ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে গোবরসারের ব্যবহার তো এখনকার দিনে অনেক চাষি বেমালুম ভুলেই গেছেন। শুধুমাত্র রাসায়নিক সার ব্যাবহারে বর্তমানে কাঙ্খিত ফলন পাওয়া যে অসম্ভব সেটাও চাষিরা ধীরে-ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। তাছাড়া আজকের দিনে রাসায়নিক সারের মূল্যবৃদ্ধির দরুণ অনেক চাষিদের জৈবসারের দিকে ঝোঁকার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। রাসায়নিক সারের ব্যাবহার পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া যাবে না, তাই রাসায়নিক সারের পরিমাণ কমিয়ে তার বিকল্প হিসাবে সঠিক পরিমানে জৈবসার প্রয়োগের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পর্যাপ্ত ফলন পাওয়াই এখন চাষিদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ পদ্ধতির প্রয়োগ: বিজ্ঞানভিত্তিক আমলকী চাষে রাসায়নিক সার, জৈব সার এবং অণুজীব জাতীয় সার সঠিক মাত্রায় প্রয়োগের মাধ্যমে উচ্চফলন পাওয়া যে সময়ের অপেক্ষা মাত্র তা চাষিভাইরা নিজেরাই নিজেদের জমিতে পরিদর্শন করতে পারবেন। অণুজীবের মধ্যে অ্যাজোটোব্যাক্টার এবং পিএসবি-র ব্যবহার সাম্প্রতিক কালে বহুল পরিমাণে বেড়েছে। কারণ এই দুটি অণুজীব জাতীয় সার প্রয়োগে মাটিতে উদ্ভিদের শিকড় মারফত শোষণ উপযোগী নাইট্রোজেন (Nitrogen) এবং ফসফরাসের (Phosphorus) পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা গাছের পর্যাপ্ত বিকাশের জন্য খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। গাছের সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশ-ই সময় পরবর্তীতে উচ্চফলনের পথকে প্রশস্ত করে। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে মাটির উর্বরতা পুনরায় আগের মতো ফিরিয়ে আনাও সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন। একটি ছয় বছরের আমলকী গাছে ৩০০:১০০:৪০০ গ্রাম এন:পি:কে জাতীয় রাসায়নিক সার, ১০ কেজি গোবরসার, ১০ কেজি কেঁচোসার, ৪০ গ্রাম অ্যাজোটোব্যাক্টর এবং ৫০ গ্রাম পিএসবি ব্যবহারে সবথেকে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। এই সম্পূর্ণ পরিমিত সার দুটি সমান ভাগে ভাগ করে (প্রথম ভাগ ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে এবং দ্বিতীয় ভাগ সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে) গাছে প্রয়োগ করতে হবে। রাসায়নিক সার ও জৈবসার ব্যবহারের কমপক্ষে ১২-১৫ দিন পরে অণুজীব জাতীয় সার গোবরসারের সঙ্গে মাখিয়ে ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।
অনুখাদ্যের আবশ্যিক ব্যবহার: আমলকী ফলের গায়ে বাদামি-বাদামি দাগ পরিদর্শিত হয়, যা অনেক সময়ই ক্রেতাকে আমলকী কেনা থেকে বিমুখ করে তোলে। উচ্চফলনের পাশাপাশি এই দিকটিরও অবশ্যম্ভাবী পর্যালোচনা দরকার। বাদামী দাগমুক্ত আমলকী পেতে হলে চাষিদের অবশ্যই জিঙ্ক ও বোরন, এই দুটি অনুখাদ্যের ব্যবহার করতেই হবে। এতে অনুখাদ্যের ঘাটতি মেটার সঙ্গে সঙ্গে গাছের সাময়িক বিকাশও পরিলক্ষিত হয়। ছয় বছরের আমলকী গাছের জন্য প্রতি লিটার জলে ৮ মিলিগ্রাম জিঙ্ক এবং ৪ মিলিগ্রাম বোরন মিশিয়ে ভাল করে গাছে স্প্রে করতে হবে। এই পরিমিত পরিমাণ জিঙ্ক ও বোরন বছরে দুবার (এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে এবং জুন মাসের শেষের দিকে) গাছে স্প্রে করা বাধ্যতামূলক। প্রতি গাছে রাসায়নিক সার, জৈবসার, অণুজীব জাতীয় সার এবং অনুখাদ্য সবকিছু মিলিয়ে আনুমানিক ৫০.০০ টাকা খরচ করার পর চাষিভাইরা আমলকী বিক্রি করে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারবেন। যা খরচের সাপেক্ষে অনেকটাই বেশি।
ঠিক এইরকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনে বাদামি দাগমুক্ত ভাল আকারের আমলকীর উচ্চফলন খুব সহজেই পাওয়া যাবে। যা বিক্রির পর প্রাপ্য লাভ দেখে চাষিরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠবেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.