ফাইল ছবি।
বাংলার চাষিভাইরা যেখানে একটু মাঝারি ও নিচু জমি আছে সেখানে ধানের সঙ্গে খুব সহজেই মাছ চাষ করতে পারেন। আধুনিক কৃষি পদ্ধতি অনুসরণ করে চাষিভাইরা বাড়তি আয় করতে পারেন। লিখেছেন মেঘালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রামোন্নয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (কৃষিজ উৎপাদন) সৈকত মজুমদার।
ধান দানাশস্য জাতীয় উদ্ভিদের মধ্যে প্রধান ফসল। ধান উষ্ণ জলবায়ুতে, বিশেষত পূর্ব-এশিয়ায় ব্যাপকভাবে চাষ হয়। ধান প্রাচীনকাল থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রধান খাদ্য হিসাবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় চিন ও জাপানের রাজাদের সাহায্য পেয়ে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে ধান চাষ শুরু হয়েছিল। বর্তমানে এই ধান লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রধান খাদ্য হিসাবে গণ্য করা হয়। বাংলার চাষি ভাইরা অনেক আগেই পশ্চিমবঙ্গ ধান চাষে সফলতা অর্জন করেছে। চাষিরা কোনও কোনও জায়গায় ধানের জমিতে মাছ চাষ করে থাকেন। তবে এই পদ্ধতিতে এখনও সবজায়গায় সমান ভাবে চাষ করা হয় না। এখন আধুনিক কৃষি পদ্ধতিতে ধান চাষের জমিতে মাছ চাষে বিশেষ সাফল্য আসছে।
বাংলার চাষি ভাইরা ধানের সঙ্গে মাছ চাষ করলে সাফল্য তো পাবেনই সাথে সাথে কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ বিপ্লব আনতে পারবেন। একইসঙ্গে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি অনুসরণ করে চাষিভাইরা বাড়তি আয় করতে পারেন।বাংলার চাষিভাইরা যেখানে একটু মাঝারি ও নিচু জমি আছে সেখানে ধানের সঙ্গে খুব সহজেই মাছ চাষ করতে পারেন। যেখানে ৪-৫ মাস জল জমে থাকে, সেখানে আমন ধানের সঙ্গে মাছ চাষ করা যায়। আবার বোরো ধানের সঙ্গেও যেসব জমিতে সেচ সুবিধা আছে, সেসব জমিতেও এ পদ্ধতি অবলম্বন করে চাষিভাইরা ধানের সঙ্গে মাছ চাষ করতে পারেন। এছাড়াও বর্ষা কালে কখনও কখনও ধানের সঙৃগে মাছ চাষ করা যেতে পারে।
ধানের জমিতে মাছ চাষের সুবিধা
১) ধানের জমিতে মাছ চাষ করলে চাষিভাইরা অতিরিক্ত ফলন পেতে পারেন, একসঙ্গে ধান ও মাছ।
২) চাষি ভাইরা অল্প জমিতে অনেক বেশি লাভ করতে পারেন ।
৩) চাষিভাইদের যদি বেশি জমি না থাকে পুকুর কেটে মাছ চাষ করার মতো সেখানে তাঁরা ধান ও মাছ চাষ এই পদ্ধতি অবলম্বন করে সহচাষ করে অনেক বেশি লাভ করতে পারেন। সেখানে তাঁদের আলাদা করে পুকুরের জন্য জমির প্রয়োজন পড়বে না।
৪) অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগের দরকার হয় না।
৫) মাছ চাষ করলে ধানের ফলনের কোনও অসুবিধা হয় না।
৬) মাছ ধানের জমিতে নিড়ানীর কাজ করে।
৭) জমিতে ধানের সঙ্গে মাছ চাষ করলে ধানের ক্ষতিকর পোকামাকড় কম হয়।
৮) মাছ ধানের জানিতে ক্ষতিকারক পোকা মাকড় খেয়ে জমিকে রক্ষা করে ও এতে ধানের উৎপাদন অনেক গুণ বেড়ে যাবে।
৯) ধানের আগাছা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চাষিভাইদের যে খরচ পড়ে তা মাছ চাষ করলে বেঁচে যায়। আগাছা নিধনের জন্য যে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এতে পরিবেশ ও ফসল রক্ষা পায়।
১০) মাছ চাষ করলে ধানের জমিতে আগাছা খুব একটা জন্মাতে পারে না।
১১) ধানের জমিতে মাছ চাষ করলে যখন মাছেরা চলাফেরা করে ক্ষেতের মধ্যে তখন জমির কাদামাটি ওলটপালট হয় যায় ফলে জমির উর্বরতা শক্তি অনেক বৃদ্ধি পায় এতে ধান গাছ অনেক বেশি পুষ্টি গ্রহণ করে মাটি থেকে।
১২) মাছের বিষ্ঠা জমিতে সার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এতে ধান ক্ষেতের উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে।
যে ধরনের মাছ চাষ করা যেতে পারে
পুঁটি, তেলাপিয়া, কই, বাটা, ট্যাংরা এই ধরনের মাছ চাষ করা যেতে পারে।
ধানখেতে মাছ চাষ পদ্ধতি
চাষি ভাইরা একসঙ্গে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ধান মাছের মিশ্র চাষ করতে পারেন।
মাছ চাষের জন্য জমি নির্বাচন
১) চাষিভাইরা সব জমিতে মাছ চাষ করতে পারবেন না। চাষিভাইদের একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে সব জমি মাছ চাষের জন্য উপযোগী নয়।
২) যে সমস্ত মাটির জল ধারণ করার ক্ষমতা বেশি ও উর্বরতা শক্তি বেশি যেমন বেলে, দোআঁশ, এঁটেল এই সব মাটিতে ধান চাষের সঙ্গে সঙ্গে মাছ চাষ করা যেতে পারে।
৩) খুব উঁচু জমি বা খুব নিচু জমি যেখানে জল ধারণ করার ক্ষমতা নেই, সেই সব জমি ধানের সঙ্গে মাছ চাষ অনুপযোগী।
৪) যেসব জমিতে বন্যার জল ঢুকতে পারে না, সেই সব জমিতে ধানের সঙ্গে মাছ চাষ করা যেতে পারে।
জমি প্রস্তুতকরণ
১) চাষিভাইদের প্রথমে চিরাচরিত নিয়মে ধান চাষের জমি ভাল করে চাষ দিয়ে, মই দিয়ে প্রস্তুত করে নিতে হবে।
২) জমিকে ভাল করে কাদা কাদা করে নিতে হবে তাতে আগাছাও পরিষ্কার হয়ে যাবে।
৩) ধান ক্ষেতের চারিদিকে ভাল করে আল দিতে হবে। জমির উচু নিচু অবস্থানের উপরে আলের পরিমাপ নির্ভর করবে।
৪) দুই থেকে তিন ফুট একটি গর্ত করতে হবে, সেটা জমির মধ্যে, পাশে বা কোণায়, যেকোনও একটি জায়গায় করতে হবে মাছ চাষের জন্য, যাতে ধান চাষের জমিতে জল শুকিয়ে গেলে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা পুকুরে মাছ আশ্রয় নিতে পারে।
৫) ধান চাষের জন্য চাষিদের প্রচলিত নিয়মে গোবর সার, জৈব সার প্রয়োগ করে ধান রোপণ করতে হবে।
মাছ নির্বাচন
১) অল্প জলে চাষ করা যায় এমন মাছ নিতে হবে।
২) খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে এমন মাছ নিতে হবে।
৩) কম অক্সিজেনে বাঁচে এমন মাছ নিতে হবে।
ধানের সঙ্গে মাছ চাষ পদ্ধতি
১) চাষিভাইদের প্রথমে যে কোনও জাতের ধানের চারা বপন করতে হবে, কি ধরনের জাত তারা বপন করবেন সেটা সম্পূর্ণ চাষিভাইদের উপর নির্ভর করবে, তারা দেশি বা হাইব্রিড যে কোনও জাতের চারা নিতে পারবেন।
২) ধানের চারা বপন করার পর পর চাষিভাইদের মাছ চাষের জন্য জোগাড় শুরু করে দিতে হবে।
৩) মোটামুটি দুই থেকে তিন একর জমি থাকলে জমির মাঝামাঝি স্থানে একটি ২০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া পুকুর কেটে নিতে হবে।
৪) চাষিভাইদের এই পুকুর কাটা পুরোটাই নির্ভর করবে তাদের জমির পরিমাপের উপর। জমি যদি বেশি হয় পুকুরের মাপ বেশি হবে, কম হলে পুকুরের মাপ কম হবে।
৫) যদি খুব গরম হয় পুকুরে কিছু কচুরিপানা রাখতে হবে জলকে ঠান্ডা করার জন্য।
৬) এবার পুকুর কাটা হয়ে গেলে জল দিয়ে ভর্তি করে দিতে হবে।
৭) ধান বপন করার পর ধানের বয়স যখন মাস খানেক ঠিক সেই সময় মাছ ছেড়ে দিতে হবে।
৮) চাষি ভাইরা চাইলে পুঁটি, তেলাপিয়া, কই, রুই, কাতলা এই ধরনের মাছ চাষ করতে পারবেন।
৯) এবার মাছের খাবার দিনে একবার দিতে হবে।
১০) যে সমস্ত মাছ ছোট ছোট মাছকে খেয়ে নেয় যেমন মাগুর, এই সব মাছ চাষ না করাই ভাল। এই সব মাছ চাষ করলে এরা ছোট ছোট মাছ খেয়ে নেবে।
১১) চাষিভাইদের বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে ধানের জমিতে যাতে কোনও প্রকার কীটনাশক প্রয়োগ না করা হয়।
১২) কীটনাশক ব্যবহার মাছ চাষের জন্য ক্ষতি করবে। মাছ মরে যেতে পারে।
১৩) চাষিদের শুধু মাত্র গোবর সার, জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
১৪) যদি কখনও ধানের জমিতে কীটনাশকের দরকার হয় সেই সময় ভাল করে আল দিয়ে মাছকে ধানের জমি থেকে আলাদা করে জমির মাঝখানে কেটে রাখা পুকুরে আটকে রাখতে হবে।
১৫) কীটনাশক প্রয়োগের সময় খুব ভাল করে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে পুকুরে কীটনাশক না যায়। তাহলে মাছের ক্ষতি হবে।
১৬) চাষিভাইরা না চাইলে সার নাও দিতে পারেন। কারণ খাবার খেয়ে মাছ যে বর্জ্য জমিতে দেবে সেটা ধানের জমিতে সার হিসাবে প্রয়োগ হবে।
১৭) এর ফলে ধানের বৃদ্ধি অনেক গুণ বেড়ে যাবে।
১৮) এবার চাষিভাইদের খুব ভাল করে খেয়াল রাখতে হবে যাতে যে জমিতে মাছ ও ধান চাষ হচ্ছে সেই জমির জলের পরিমাপ যেন এক থেকে দেড় ফুটের বেশি না হয়। জলের পরিমাপ বেশি হয়ে গেলে চাষের ক্ষতি হতে পারে।
১৯) আরও ভাল করে লক্ষ্য রাখতে হবে ক্ষেতের জল যেন একদম শুকিয়ে না যায়, এতে ধান ও মাছ উভয়েই অসুবিধার মধ্যে পড়বে।
২০) চাষিভাইরা যদি প্রতিদিন জলের পরিমাপ ঠিকমতো রাখেন তাহলে কোনও অসুবিধা হবে না।
২১) কোনও কারণে ক্ষেতের জল যদি একদম শুকিয়ে যায় তাহলে আগে থেকে চাষিভাইরা যে পুকুর কেটেছিল সেখানে মাছ চলে যাবে ও নিরাপদে আশ্রয় নেবে।
২২) এবার জমির চারিদিকে ভাল করে নেট দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।
২৩) এবার ধান কাটার সময়, ধান পেকে গেলে ধান ক্ষেতের জল যখন কমে যাবে মাছ তখন আগে থেকে কেটে রাখা পুকুরে চলে যাবে।
২৪) ধান কাটা হয়ে গেলে মাছ তোলার পালা।
২৫) এই ভাবে চাষ করা মাছ স্বাদে ও ওজনে অনেক গুণ বেশি হবে।
২৬) এইভাবেই ধান ও মাছ চাষ খুব সহজেই নির্দিষ্ট কিছু বৈজ্ঞানিক নিয়ম মেনে করলে ফলন হবে দুইগুণ, একসঙ্গে মাছ ও ধান। অনেক সময় জায়গা বিশেষ ধানের ফলন দশ থেকে বারো গুণ বেড়ে যায়।
২৭) এই ভাবে ধান মাছের মিশ্র চাষে চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে প্রতি হেক্টর জমিতে ৩৫০–৪০০ কেজি মাছ পাওয়া যাবে।
সতর্কতা অবলম্বন
১) ধানের জমিতে ক্ষতিকারক কীটনাশক প্রয়োগে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
২) জল পরিমাপ যেন খুব বেশি বা কম না হয়ে যায়।
৩) চাষিভাইদের খুব ভাল করে ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.