পেঁচা কৃষকের পরম বন্ধু। এর খাদ্যতালিকায় থাকে গুবরে, মথ, পঙ্গপাল, ঘাসফড়িং, ঝিঁঝিঁপোকা, টিকটিকি, গিরগিটি, ছোট পাখি, ইঁদুর ইত্যাদি। বৈদ্যুতিক আলোর চারপাশে উড়ে বেড়ানো পতঙ্গ ধরে নিয়ে গিয়ে নিজের পছন্দসই জায়গায় বসে খায়। একটি লক্ষ্মীপেঁচা বছরে দুই থেকে ছয় হাজার পর্যন্ত ইঁদুরকে শস্যখেত থেকে ধরে। ইঁদুরের মাধ্যমে ফসলের ক্ষতি কমে। কীটপতঙ্গ খেয়ে ফসল রক্ষা করে। ফলে উপকৃত হন কৃষক। লিখেছেন পরিবেশবিদ শাশ্বতী রায় রিভস।
সারা পৃথিবীতে প্রায় ২০০ প্রজাতির পেঁচা দেখা যায়। উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর তুষারাবৃত অঞ্চল এবং কয়েকটি নির্জন দ্বীপ ছাড়া সর্বত্র এদের ঘোরাফেরা। আমাদের দেশে প্রায় ৩৫ রকমের পেঁচা দেখা যায়।। এদের মুখ চ্যাপ্টা, চোখজোড়া মুখের সামনের দিকে। কান মাথার উপরে খাড়া হয়ে থাকে, কানের চারপাশে পালক এমনভাবে সাজানো যাতে করে বহুদূর থেকে ভেসে আসা শব্দও কানে প্রবেশ করে। অল্প আলোয় শিকারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য এদের চোখকে দূরবীনের মত ব্যবহার করে। এমনকি নিজের ঘাড় ২৭০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে শিকারের অবস্থানও লক্ষ্য করতে পারে। সন্ধ্যের আধো আলোয় শিকার করবে নাকি গভীর রাতে শিকার করবে- তা নির্ভর করে এদের চোখের রঙের উপর।
চোখের গাঢ় রঙ রাতে শিকার করার জন্য, কমলা রঙ সন্ধ্যের অল্প আলোতে আর হলুদ রঙের চোখের পেঁচা অল্প আলোতে বা নিশীথ রাতে সমানভাবে শিকার ধরে। তবে পেঁচা খুব কাছের জিনিস ভাল দেখতে পায় না। আমাদের চাষের ক্ষেতের আশেপাশে যেসব পেঁচা সবথেকে বেশি দেখা যায় সেগুলি হল লক্ষ্মী পেঁচা বা বার্ণ আউল, কুটুরে পেঁচা বা স্পটেড আউলেট, হুতুম পেঁচা বা ব্রাউন ফিশ আউল, ভুতুম পেঁচা বা ব্রাউন হক আউল, নিম পেঁচা বা স্কপস আউল।
এদের খাদ্যতালিকা ঘাঁটাঘাঁটি করলে জানা যাবে কেন এরা কৃষকের পরম বন্ধু। এরা শিকারী পাখি, অন্য প্রাণীদের মেরে খাওয়াই এদের অভ্যাস। আমাদের সবথেকে পরিচিত কুটুরে পেঁচাদের সন্ধ্যের আগে থেকেই গাছে, টেলিগ্রাফ পোষ্টে, কার্নিশে সারিবদ্ধভাবে বসে থাকতে দেখি। এরা তখন শিকারের আশায় বসে থাকে- খাদ্যতালিকায় থাকে গুবরে, মথ, পঙ্গপাল, ঘাসফড়িং, ঝিঝিপোকা, টিকটিকি, গিরগিটি, ছোট পাখি, ইঁদুর ইত্যাদি। বৈদ্যুতিক আলোর চারপাশে উড়ে বেড়ানো পতঙ্গ ধরে নিয়ে গিয়ে নিজের পছন্দসই জায়গায় বসে একপায়ে ধরে এমন ভাবে খায় যেন টিয়াপাখি খোসা ছাড়িয়ে বাদাম খাচ্ছে।
হুতুম পেঁচা বাস করে জলাশয়ের কাছাকাছি বড় গাছের কোটরে। মাছ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, ইঁদুর আর বড় ধরণের পোকামাকড় খায়। ভুতুম পেঁচাও খায় ইঁদুর আর ছোট পাখি, পোকামাকড়। নিম পেঁচা খায় কেবলমাত্র কীটপতঙ্গ। আর লক্ষ্মী পেঁচা, মূলত পৌরাণিক আখ্যান থেকে আধুনিক কবিতা – সর্বত্র যাদের কৃষকের পরম বন্ধু বলা হয়, তাদের প্রধান খাদ্য ইঁদুর। গবেষণায় জানা গেছে একটি লক্ষ্মীপেঁচা বছরে দুই থেকে ছয় হাজার পর্যন্ত ইঁদুরকে শস্যক্ষেত থেকে ধরে। এদের শিকার পদ্ধতি হল গভীর রাতে শুধুমাত্র শিকারের নড়াচড়া বা ডাকার শব্দ শুনে আক্রমণ করা। এরা যেখানে থাকে তার এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধে শিকার করে। প্রায় তিনশো হেক্টর জমির শিকার এরা এককভাবে করতে পারে। প্রজনন কাল ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে স্ত্রী ও পুরুষ পাখি আলাদা এলাকায় থাকে। শিকার ধরার জন্যে হালকা হাওয়ায় ভেসে চলে শস্যক্ষেতের উপরে, শিকার দেখতে পেলে নিঃশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তাহলে যদি শস্যক্ষেতে লক্ষ্মীপেঁচা বা অন্যান্য পেঁচা ডেকে আনা যায়, তবে কীটনাশকের ব্যবহার কমে যেতে পারে। ভারতে বছরে ২-১৫ শতাংধ শস্য ইঁদুরদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইঁদুর মারার জন্য রাসায়নিক কীটনাশক বহুল ব্যবহৃত। এর খরচও অত্যন্ত বেশি। কিন্তু এইকাজে পেঁচাকে ব্যবহার করলে তা হবে কম ব্যয়সাপেক্ষ এবং পরিবেশ বান্ধব। গবেষণায় দেখা গেছে, পেঁচাদের খাদ্যতালিকায় ১৩ রকমের বেশি ইঁদুর আছে, এছাড়াও নানারকম পোকামাকড়, যারা চাষের ক্ষতি করে তাদেরকেও পেঁচা খায়। অর্থাৎ সুষম চাষে এদের অবদান আছে।
বর্তমানে ক্ষেতক্ষামারে পেঁচাদের দেখা যাচ্ছে না বলে অনেক কৃষকেরা আফশোষ করেন। তাই এই উপকারী বন্ধুদের আবার ক্ষেত জমিতে ফিরিয়ে আনতে আমাদের কিছু পন্থা অবলম্বন করতে হবে। প্রথমতঃ ক্ষেতের মাঝে মাঝে কিছু খুঁটি পুঁতে রাখতে হবে যাতে করে রাতে এসে বসতে পারে। আর সম্ভব হলে পেঁচাদের জন্য কৃত্রিম বাসার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ব্যবস্থা ক্ষেতের আশেপাশে করতে হবে। ইজরায়েলে শস্যক্ষেতে ইঁদুরের উৎপাত কমাতে ১৯৮৩ সালে একটি প্রোজেক্ট শুরু করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ক্ষেতের পাশে চোদ্দটি কৃত্রিম বাসা বসানো হয়। লক্ষ্মী পেঁচারা সেইসব বাসার দখল নেয় এবং ক্ষেত থেকে ইঁদুর ধরতে শুরু করে। ফলে ক্ষেতে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমতে থাকে।
বর্তমানে সেখানে খেতে পাঁচ হাজারেরও বেশি কৃত্রিম বাসা বসানো হয়েছে। এতে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার যেমন কমেছে তেমন পরিবেশেরও উন্নতি হয়েছে। আবার কৃষকের লাভের পরিমাণও বেড়েছে, আর লক্ষ্মীপেঁচার সংখ্যাও বেড়েছে। যেহেতু পাখি দেশ বিদেশের গণ্ডি মানে না, তারা পার্শ্ববর্তী জর্ডন ও প্যালেষ্টাইনেও চলে যাচ্ছে। এতে সেই দেশের কৃষকদেরও লাভ হচ্ছে। এদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সাইপ্রাস, গ্রীস, আরব আমীরশাহী একই পদ্ধতি অবলম্বন করছে। আমরাও আমাদের শস্যক্ষেতে এইরকম কৃত্রিম বাসা প্রতিস্থাপন করতে পারি। আমাদের লক্ষ্য সুস্থায়ী উন্নয়ন। পরিবেশের প্রত্যেকটি সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে অহেতুক কীটনাশক প্রয়োগ না করে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে কৃষকের লাভ সবথেকে বেশি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.