অসংখ্য পুষ্টিগুণে ভরপুর মিষ্টি আলু। সেই কারণে এটিকে সুপার ফুড নামে ডাকা হয়। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, আমেরিকা, আফ্রিকা সহ প্রায় সব নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেই এই মিষ্টি আলুর চাষ ভাল হয়। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ফসলের মধ্যে না পড়লেও মিষ্টি আলু চাষ কিন্তু বেশ লাভজনক। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শস্য বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক সুস্মিতা মঈ এবং বাপ্পা মণ্ডল।
আমাদের রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং বাঁকুড়া জেলায় ব্যাপকভাবে চাষ হয়ে থাকে এই মিষ্টি আলু। এই আলু সিদ্ধ করে ও পুড়িয়েও খাওয়া যায়। সবজি হিসেবে কন্দমূল, পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়। এছাড়াও পাতলা ‘স্লাইস’ সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে পরে তেলে ভেজে ‘ক্র্যাকার্স’ হিসেবেও খাওয়া যায়। স্যুপ বানাতেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। মিষ্টি আলুর থেকে খুব সুস্বাদু মিষ্টিও তৈরি হয়।
পুষ্টিগুণ: লাল মিষ্টি আলুর রাঙা আবরণে যে পরিমাণ পুষ্টি উপকরণ থাকে, তা সাদা মিষ্টি আলুর তুলনায় অনেক বেশি। একটি আলুতে আছে ১০০ ক্যালোরি, ২ গ্রাম প্রোটিন, ২২ গ্রাম শ্বেতসার, ৩ গ্রাম আঁশ, ০ গ্রাম চর্বি। এছাড়া একটি মিষ্টি আলু থেকে প্রতিদিনের চাহিদার ২৬ ভাগ ভিটামিন এ, ১২.৬ ভাগ ভিটামিন বি-৬ ও ২৮ ভাগ ভিটামিন সি পাওয়া যায়। মিষ্টি আলু ভিটামিন সি এবং ডি-এর সমৃদ্ধ উৎস। ভিটামিন সি ঠাণ্ডা লাগা প্রতিরোধে ও ভিটামিন ডি স্বাস্থ্যকর হাড়, হৃৎপিণ্ড, স্নায়ু, ত্বক ও দাঁতের জন্য জরুরি। ভিটামিন সি দাঁত, হাড় এবং কোষ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্ষত সারাতে, শরীরে কোলাজন উৎপাদন করে ত্বকের নমনীয়তা ধরে রাখতে ভিটামিন সি-এর প্রয়োজন হয়।
আয়রনের উৎস: মিষ্টি আলু আয়রনেরও ভাল উৎস। এটি আমাদের শরীরে শ্বেত রক্ত কণিকা তৈরি, চাপ প্রতিরোধ, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর রাখা সহ নানা কাজে আসে।
অন্যান্য খনিজ উপাদান: মিষ্টি আলুতে ম্যাঙ্গানিজ ও পটাশিয়ামও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। ধমনী, রক্ত, হাড় ও মাংস পেশির সুস্থতায় ও স্নায়ুর সুষ্ঠু ভাবে কাজ করার জন্য ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ: মিষ্টি আলু প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টি হয়। যা রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাকৃতিক চিনি কাজের শক্তি প্রদান করে অবসাদ, ক্লান্তি দূর করে থাকে। মিষ্টি আলুতে প্রাকৃতিক ভাবে চিনি থাকলেও তা খুব ধীরে ধীরে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। এতে শরীর শুধু শক্তির নিয়মিত জোগানই পায় না, শরীরে শক্তির ভারসাম্যও বজায় থাকে। এটি শর্করা হলেও বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মিষ্টি আলু রক্তের সুগারের মান সুস্থিতিতে এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমাতে বেশ উপযোগী। এতে আরও কিছু উপাদান আছে, যা রক্তের সুগার কমাতে উপযোগী।
পেটের রোগ প্রতিরোধ: ইরিটিবেল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) এবং আলসারেটিভ কোলাইটিসের মতো পেটের রোগেও মিষ্টি আলু উপকারী। মিষ্টি আলুতে আরও রয়েছে প্রদাহরোধী গুণ। এতে ফাইটো-নিউট্রিয়েন্ট আছে, সেগুলো প্রদাহ সূচক গুলো হ্রাসে সহযোগী।
হৃদরোগে এবং হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখতে: মিষ্টি আলু ভিটামিন বি-৬ এর একটি ভাল উৎস। এটি আমাদের শরীরে হোমোসাইস্টিন নামের কেমিক্যাল কমাতে সহায়তা করে। এই কেমিক্যাল হৃদরোগ- সহ নানা ধরনের অসুখের অন্যতম কারণ। পটাশিয়াম হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক রাখতে, কিডনি সুরক্ষায় ও একে কর্ম-ক্ষমতা স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখে। হাভার্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল অব পাবলিক হেল্থ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন বি-৬ রয়েছে, যা রক্তের হমোসাইটিনিন ভেঙ্গে দিয়ে রক্তের ধমনী এবং শিরায় রক্ত চলাচল সচল রাখে। এর পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রেখে হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া ইলেক্ট্রোলাইট হার্ট-বিট নিয়মিত রাখে।
রাতকানা রোগ সারায়: রাতকানা রোগের ক্ষেত্রেও মিষ্টি আলুর উপকারিতা লক্ষ্য করা যায়। মিষ্টি আলুতে যে সব ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট রয়েছে তা ভারি ধাতু ও মুক্ত মূলকের সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস করার ব্যাপারে বেশ সহায়ক।
ক্যানসার প্রতিরোধক: দেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হল বিটা-ক্যারোটিন। একটি মাঝারি আকৃতির মিষ্টি আলুতে ভিটামিন এ এবং বিটা-ক্যারোটিন রয়েছে। ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা, দৃষ্টি শক্তি ভাল রাখতে সাহায্য করে। এই বিটা ক্যারোটিন প্রস্টেট ক্যানসার, কোলন ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
দুশ্চিন্তা নিরাময়: মিষ্টি আলুতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম স্বাস্থ্যকর রক্ত, হাড়, হার্ট, পেশী এবং নার্ভ গঠন করতে সাহায্য করে। এছাড়া ম্যাগনেসিয়াম স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা দূর করে মন চিন্তা মুক্ত রাখতে সাহায্য করে। ন্যাশনাল হেল্থ অ্যান্ড নিউট্রিশন এক্সামিনেশন সার্ভে প্রকাশ করেছে যে, ২ ভাগ আমেরিকান প্রতিদিন ৪৭০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম সাপ্লিমেন্টারি গ্রহণ করে। অথচ একটি মাঝারি আকৃতির মিষ্টি আলুতে রয়েছে ৫০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম। মেডিকেল নিউজ ডেইলির মতে, প্রতিদিন পটাশিয়াম গ্রহণ প্রায় ২০ ভাগ বিভিন্ন রোগে মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাস করে থাকে। তাই যথাযথ নিয়ম মেনে এই ফসল চাষ করলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ লাভজনক ফল পেতে পারেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.