Advertisement
Advertisement
Nematodes

গাছের পুষ্টি জোগান, কীটশত্রু দমনে কৃমির জুড়ি মেলা ভার

মাটিতে বসবাসকারী বেশিরভাগ কৃমি গাছের ক্ষতি করে না।

Nematodes helps farmers, says experts
Published by: Sayani Sen
  • Posted:July 4, 2024 7:07 pm
  • Updated:July 4, 2024 7:07 pm  

নেমাটোড বা কৃমি পরজীবী প্রাণী। যে কোনও প্রাণীর শরীরে পরজীবী হিসাবে বাসা বাঁধতে পারে। মাটির জীবকুলের একটা বড় অংশ হল কৃমি। জীবজগতের সমস্ত বহুকোষী প্রাণীর প্রায় ৮০ শতাংশই প্রতিনিধিত্ব করে কৃমি। মাটিতে বসবাসকারী বেশিরভাগ কৃমি গাছের ক্ষতি করে না। মাটির স্বাস্থ্য সুস্থায়ী করতে ও গাছের খাদ্য ও পুষ্টি দিতে সাহায্য করে। কীটশত্রু দমনও করে। লিখেছেন নতুন দিল্লির ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কৃমি বিজ্ঞানী অধ্যাপক মতিয়ার রহমান খান।

নেমাটোড বা কৃমি হল বহু কোষী (দেহ বহু কোষ দিয়ে তৈরি) পরজীবী প্রাণী। মানুষ, কীটপতঙ্গ পশু-পাখি যে কোনও প্রাণীর শরীরে পরজীবী হিসাবে বাসা বাঁধতে পারে। সমুদ্রের গভীর থেকে পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত সর্বত্রই কৃমি পাওয়া যায়। এক কোদাল মাটিতে এক ১০ লাখের বেশি কৃমি থাকতে পারে! মাটির জীবকূলের একটা বড় অংশ হল কৃমি। জীবজগতের সমস্ত বহুকোষী প্রাণীর প্রায় ৮০ শতাংশই প্রতিনিধিত্ব করে কৃমি। এদের অভিযোজন আশ্চর্যজনক এবং অত্যন্ত সফল প্রাণী। এই গ্রহের প্রায় প্রায় সর্বত্রই বিরাজমান। আমরা সচরাচর যে কৃমিগুলোর কথা শুনি তারা অধিকাংশই মাটিতে থাকে। এদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক (দুই থেকে পাঁচ শতাংশ) কৃষি ফসলের সমস্যা করে। প্রাণীপরজীবী কৃমিও কম থাকে না। মানুষের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল কৃমি (পেটের ভিতরে অন্ত্রে যে সব কৃমি থাকে) রোগ আসলে মাটি বাহিত। মানুষের রক্তে, চামড়ায়, কোষকলায় কৃমি আক্রমণ করে। এটা জেনে রাখা দরকার বেশির ভাগই মাটিতে বসবাসকারী কৃমি গাছের ক্ষতি করে না। মাটির স্বাস্থ্য সুস্থায়ী করতে ও গাছের খাদ্য ও পুষ্টি দিতে সাহায্য করে। কীটশত্রু দমন করে।

উপকারী কৃমি

এদের খাদ্যাভ্যাস অনুসারে, মাটিতে বসবাসকারী কৃমিদের পাঁচটি ট্রফিক গ্রুপে (খাদ্য শৃঙ্খলে) ভাগ করা হয়। যেমন ব্যাক্টেরিয়াভোজী, ছত্রাকভোজী, উদ্ভিদভোজী (পরজীবী), সর্বভুক এবং পরভোজী (শিকারী)। এদের বৈচিত্র্য মূলত মাটির গঠন, মাটির আর্দ্রতা এবং খাদ্যের প্রাপ্যতার দ্বারা প্রভাবিত হয়। মাটিতে বসবাসকারী মুক্তজীবী কৃমি (যেমন ব্যাকটেরিভোর, ছত্রাকভোজী, সর্বভুক এবং পরভোজী) উপকারী কৃমি হিসাবে পরিচিত। প্রাচুর্য এবং বৈচিত্র্যের দিক থেকে মুক্ত-জীবী কৃমি, গাছের পরজীবীদের (উদ্ভিদভোজী) চেয়ে অনেক বেশি। এরা বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারিতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাটির পচন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং উদ্ভিদ খাদ্যের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করে এবং এইভাবে, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।

Advertisement

কৃমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে (i) খাদ্য উৎপাদনের মূল প্রক্রিয়াগুলিকে চালিত করে; (ii) জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, মাটির ভিতরে এবং বাইরে কার্বনের স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে; এবং (iii) পচন, পুষ্টিচক্র এবং কীটপতঙ্গ এবং রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রণের মতো প্রক্রিয়াগুলিকে প্রাভাবিত করে। মাটির স্বাস্থ্য নির্ভর করে মুক্ত-জীবী কৃমির সংখ্যার তারতম্যের উপর। তাছাড়া এরা উদ্ভিদ পরজীবী কৃমির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। কীটপতঙ্গের রোগ সৃষ্টিকারী কৃমি (এন্টোমোপ্যাথোজেনিক নেমাটোড- ইপিএন) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফসলের পোকামাকড়ের ব্যবস্থাপনার জন্য খুব কার্যকারী জৈব-নিয়ন্ত্রক। এদের দুটি প্রজাতি -স্টেইনারনেমা এবং হেটেরোরাবড়িটিস কীটশত্রু দমনে ব্যবহৃত হয়।

[আরও পড়ুন: শুকনো ফুলই নয়, ছাল-মূল-কাণ্ডের ফিউশনে হতে পারেন বিপুল লাভবান]

অপকারী কৃমি
কিছু কৃমি গাছের পরজীবী। সাধারণত এক ইঞ্চির ১০ ভাগের এক ভাগ (২ মিমি থেকে কম) লম্বা এবং অধিকাংশই খালি চোখে দেখা কঠিন। কিন্তু বছরে প্রায় ২১ % ফসলের ক্ষতি করে। যা প্রায় ১.৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান! গাছে আক্রমণকারী কৃমির মুখে একটি ধারালো সূচের মতো গঠন থাকে যাকে বলা হয় ‘স্টাইলেট’ (বর্শা)। বর্শাটি খুব ছোট ইঞ্জেকশনের সূচের মতো কাজ করে এবং কোষের প্রাচীর ভেদ করে কোষীয় রস চুষে খায়। ফলে শিকড়ে অসংখ্য ক্ষত তৈরি হয়। কৃমিজনিত উদ্ভিদ রোগের উপরের লক্ষণগুলি শনাক্ত করা কঠিন, এবং প্রায়শই পুষ্টির ঘাটতির লক্ষণগুলির সাথে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সাধারণত, গাছপালা বৃদ্ধি পায় না, স্বাভাবিকের চেয়ে ফ্যাকাশে বা হলুদ হয় এবং দিনের রোদ তাপে শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত গাছগুলি প্রায়শই ছোট পাতা সহ বামন হয়। কখনও কখনও, সংক্রামিত গাছগুলি আর্দ্র, উর্বর মাটিতে বা শীতল আবহাওয়ায় স্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়, ফলে উপরের অংশগুলি স্বাস্থ্যকর বলে মনে হতে পারে। আসলে কৃমি গাছের সুষম পরজীবী।

এরা গাছকে মারতে চায় না, গাছের উপর নির্ভরশীল পরজীবী। অনেক সময়, কৃমি আক্রান্ত গাছ মরতে দেখা যায়। তার কারণ হল, গাছ মাটি থেকে পর্যাপ্ত খাবার ও জল নিতে পারে না। তার সঙ্গে মাটিতে গাছের রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া জীবাণুগুলো ঢুকে পড়ে গাছের বিপত্তি ঘটায়। স্বাভাবিকভাবে জমিতে প্রায় সব রকম ফসলের জটিল রোগ তৈরি হয় যা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। কৃমি আক্রান্ত গাছের সাধারণ লক্ষণ যেমন শিকড় ফোলা, গাঁট যুক্ত শিকড়। যা এক ধরনের কৃমি (মেলোইডোগাইনি), প্রায় সব ফসলের ক্ষতি করে। আক্রমণকারী আজুবা দশা, যা জুভেনাইল নামে পরিচিত, গাছে আক্রমণ করে, দ্রুত বংশবৃদ্ধি হয়ে একটি গাছে লক্ষাধিক সংখ্যায় পৌঁছায়। এই ক্ষুধার্ত মুখ পরবর্তী ফসলকে আক্রমণের অপেক্ষায় থাকে। তাই ফসল চাষের আগে মাটিতে কৃমির শনাক্তকরণ, কৃমির সংখ্যা এবং তুলনামূলকভাবে অপকারী (গাছের পরজীবী) কৃমির উপস্থিতি যাচাই করা খুব দরকার।

অত্যন্ত অপকারী কৃমি
বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি প্রচলিত রোগ গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল (GI রোগ) যা মাটিবাহিত কৃমির সংক্রমণ হলে হয়। কৃমি রোগ আসলে ‘উপেক্ষিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। মানুষ ৩৪২ প্রজাতির কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হয়। এটি অনুমান করা হয় যে বিশ্বব্যাপী ৩.৫ বিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। যার মধ্যে ৪৫০ মিলিয়ন ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ হয়। বেশিরভাগই শিশু। প্রায় ৪৪ মিলিয়ন গর্ভবতী মহিলা হুকওয়ার্ম দ্বারা সংক্রামিত। কৃমি আক্রমণের ফলে বছরে আনুমানিক ১২৫,০০০ মৃত্যু ঘটে। প্রধানত হুকওয়ার্ম, অ্যানসাইলোস্টোমা ডুওডেনেল এবং নেকেটর আমেরিকানস বা রাউন্ডওয়ার্ম, অ্যাসকারিস লুমব্রিকোয়েডস সংক্রমণের কারণে ঘটে। ম্যালেরিয়ার সংক্রমণে প্রতি বছর ৩০০-৫০০ মিলিয়ন মৃত্যু হয়। এই সংখ্যাটি GI রোগ (কৃমির কারণে) সংক্রমণের তুলনায় অনেক কম।

কৃমির আক্রমণ হলে গুরুতর রোগ হতে পারে। যেমন গোদ সৃষ্টিকারী উচেরিয়া ব্যানক্রফটি বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে আক্রমণ করে। বিশ্বব্যাপী ৪৪ টি দেশে ৮৮২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই পরজীবী দ্বারা সংক্রামিত হয়। বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলের মানুষ এই ধরণের কৃমির শিকার হয়। এটি বেশ বড়, ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়, মশার কামড়ে ছড়িয়ে পড়ে, লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের ক্ষতি করে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে ফোলাভাব বা গোদ সৃষ্টি করে যা ‘এলিফ্যান্টিয়াসিস’ নামে পরিচিত। মানুষের অন্ত্রে ও কলাকোষে কৃমির আক্রমণ হয়।

অন্ত্রের কৃমি আক্রমণ
এরা সবচেয়ে সাধারণ পরজীবী কৃমি যা মানুষকে সংক্রমিত করে। এর মধ্যে রয়েছে অস্ক্যারিস লুম্ভরিকোয়েড (গোলকৃমি ), ট্রাইকুরিস ট্রাইকুরা (চাবুক কৃমি ) এবং হুকওয়ার্ম (নেকাটার আমেরিকানাস এবং আঁকিলোস্টোমা ডুওডেনাল ) এর মতো প্রজাতি। দূষিত খাবারে কৃমির ডিম থাকে বা মাটির সাথে ত্বকের সংস্পর্শে কৃমি সংক্রমণ ঘটে। কৃমি আক্রান্ত ব্যক্তির হালকা পেটের অস্বস্তি থেকে গুরুতর অপুষ্টি এবং রক্তশূন্যতা পর্যন্ত হতে পারে।

কলা কোষে কৃমি আক্রমণ

লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিসের জন্য দায়ী ফাইলেরিয়া কৃমি (উচেরিয়া ব্যানক্রফটি, ব্রুগিয়া মালাই এবং ব্রুগিয়া টিমোরি ) এবং অনকোসারসিয়াসিস (অনকোসারকা ভলভুলাস), লিম্ফ্যাটিক এবং সাবকুটেনিয়াস টিস্যুতে থাকে। লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং শরীরের অঙ্গগুলির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটায়, ব্যথা, গুরুতর অক্ষমতা এবং সামাজিক সমস্যার কারণ হতে পারে। এই সংক্রমণগুলি প্রায়শই গোদ এবং রিভার ব্লাইন্ডনেসের মতো শরীরের অঙ্গ বিকৃতি করে। এই ধরণের বিকলাঙ্গ ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে অসমর্থ হয়। তার আর্থ-সামাজিক অবস্থাও মারাত্বকভাবে প্রভাবিত হয়।মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী বিভিন্নভাবে পরজীবী কৃমি সংক্রামিত হয়।

অল্প সিদ্ধ মাংস খেলে, কাঁচা শাকসবজি (স্যালাড), ফল ইত্যাদি মাটি থেকে তুলে খেলে বা মলের সংস্পর্শে এলে, দূষিত পানি পান করলে কৃমি রোগ হতে পারে। তাই ভাল করে হাত ধুয়ে খাবার খাওয়া, সবজি, ফল ধুয়ে খাওয়া, খোলা আকাশে পায়খানা না করা, এবং বিশুদ্ধ পানি পান করা খুব প্রয়োজন। কিছু প্রজাতির কৃমি প্রাণীদের পেটে বাস করে এবং শরীর থেকে পুষ্টি শোষণ করে নেয়। তাই মানুষ ও আমাদের এবং গবাদি পশুকে মাঝে মাঝে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হয়। খেয়াল রাখতে হবে কৃমি যেন আমাদের শরীরে বাসা বাঁধতে না পারে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রা করতে পরজীবী কৃমি আমাদের শরীরে ঢুকতে পারবে না।

[আরও পড়ুন: আটকে পড়েছিলেন রোহিতরা, জামাইকা জুড়ে তাণ্ডব সেই হারিকেন বেরিলের, মৃত অন্তত ৯]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement