রান্নাঘরের অবশিষ্টাংশ বা বর্জ্য ও অন্যান্য জৈব আবর্জনা জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করে মাটির উর্বরতা এবং উৎপাদন ক্ষমতা ঠিক রাখা যায়। এতে পরিবেশের ভারসাম্যও বজায় থাকে। রান্নাঘরের বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে সেটি যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তেমনই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। জৈব বর্জ্যগুলিকে যত্রতত্র না ফেলে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে (জৈব সার হিসাবে) ব্যবহার করলে আমাদের এবং পরিবেশের স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। একইসঙ্গে মাটির ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম সুসংহত হয়ে উঠবে। লিখেছেন রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ এডুকেশনাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের শস্য বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক সৈকত দে এবং অধ্যাপক ড. কাজল সেনগুপ্ত।
রান্নাঘরের বর্জ্য থেকে প্রাপ্ত জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব এবং তাপমাত্রার সাম্য বজায় থাকে। মাটির মধ্যে বায়ু চলাচল এবং মাটির জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ে ও গাছ বিভিন্ন রকমের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পায়। মাটিতে প্রয়োগ করা রাসায়নিক সার জৈব পদার্থ ধরে রাখে ও গাছের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় নিয়ে আসতে সাহায্য করে। এছাড়া রান্নাঘরের অবশিষ্টাংশগুলিকে কম্পোস্ট সার, কেঁচো সার তৈরির কাজে ব্যবহার করলে মাটির কার্যক্ষমতা বাড়ে এবং কৃষিজাত ও ব্যবস্থাপনা গুলি টেকসই হয়।
রান্নার অবশিষ্টাংশ এবং জৈব আবর্জনা: গৃহস্থালির বর্জ্য:
বাড়িতে দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় যে কোনও কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ যেগুলি আমাদের কোনও কাজে লাগে না অর্থাৎ ফেলে দেওয়া হয় সেগুলিকে গৃহস্থালির বর্জ্য বলে। যাবতীয় বর্জ্যের মধ্যে গৃহস্থালি বর্জ্যের পরিমাণই সর্বাধিক। যেমন শাকসবজির ও ফলের খোসা, ফেলে দেওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া ফল বা শাকসবজি (বেশি পাকা বা পচা), ডিমের খোলা, ব্যবহৃত চা পাতা, ইত্যাদি। এছাড়াও তরল বর্জ্যের মধ্যে যেমন রান্নাঘরের থালাবাসন ধোয়া জল, ঘর মোছার জল, মাছ-মাংস এবং সবজি ধোয়া জল, এগুলি হল গৃহস্থলীর বর্জ্যের প্রধান উৎস।
রান্নাঘরের বর্জ্য পদার্থের পুষ্টিমান:
আমরা যেসব ফল বা শাক সবজি খাই সেগুলির খোসা যত্রতত্র ফেলে না দিয়ে কম্পোস্ট সার তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যায় অথবা সরাসরি গাছের গোড়ায় জৈব পদার্থ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এসব পদার্থে উদ্ভিদের খাদ্য উপাদান যথেষ্ট থাকে। কলার খোসা থেকে প্রচুর পরিমাণে ফসফেট ও পটাশ থাকে। পেঁয়াজ ও আলুর খোসার মধ্যে বেশকিছু পদার্থ থাকে যারা ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক দমন করতে পারে। এছাড়াও ফল ও শাক সবজির খোসা থেকে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন পাওয়া যায়। শাক, সবজি বা ডিম সিদ্ধ করা জলকে আমরা চাষের মাটিতে দিতে পারি। এতে প্রচুর পরিমাণে গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান থাকে।
আমরা সাধারণত ডিম খাওয়ার পর ডিমের খোলা ফেলে দিই। ওই ডিমের খোলাগুলি আমরা গাছের সার হিসাবে প্রয়োগ করতে পারি ডিমের খোলাতে ৯০ শতাংশেরও বেশি খনিজ পদার্থ থাকে। যার বেশির ভাগটাই থাকে ক্যালসিয়াম কার্বনেট। যেটা গাছের বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাদামের খোলা মাটিতে ক্যালসিয়াম যোগ করে এবং মাটির মধ্যে বায়ু চলাচল করতে সাহায্য করে। এছাড়া আরও অনেক জৈব বর্জ্য আছে যাতে প্রায় সব ধরনের খনিজ পদার্থ কম বেশি পাওয়া যায়। রান্নাঘরের অবশিষ্টাংশ অন্যান্য জৈব বর্জ্য গুলিকে আমরা বিভিন্ন উপায়ে গাছের কাজে ব্যবহার করতে পারি। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পদ্ধতি হল:
১) ঘরোয়া সবজির বাগানের জৈব সার হিসাবে।
২) কেঁচো সার এবং কম্পোস্ট সার তৈরি করতে। ঘরোয়া সবজির বাগান তৈরির মাধ্যমে আমরা খুব সহজে এবং সঠিকভাবে জৈব আবর্জনা গুলিকে সুষম সার হিসেবে চাষের কাজে ব্যবহার করতে পারি। এই সুষম সার বাড়িতেই বিনা খরচে খুব সহজ পদ্ধতিতে তৈরি করা সম্ভব। যার মধ্যে গাছের সব ধরনের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থাকে। এছাড়াও রান্নাঘরের অবশিষ্টাংশ বা জৈব বর্জ্য গুলিকে কম্পোস্ট সার এবং কেঁচো সার তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।
এই কেঁচো সার ব্যবহার করে আমরা রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে পারি। কেঁচো অর্ধপচা জৈব পদার্থ খেয়ে মল আকারে তা বের করে দেয় এবং একেই কেঁচো সার বলা হয়। কেঁচোর মলে জমির মাটির তুলনায় চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি নাইট্রোজেন ৫-৭ গুণ বেশি ফসফেট ও ১১ গুণ বেশি পটাধ পাওয়া যায়। এদের খাদ্যনালীতে মাটির তুলনায় প্রায় এক হাজার গুণ বেশি উপকারী জীবাণু থাকে যা অল্প সময়ে জৈব পদার্থকে হিউমাসে পরিণত করে। মাটিতে পিএইচের ভারসাম্য বজায় রাখতে কেঁচো সারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া মাটির মধ্যে বাতাস চলাচল ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করে।
কম্পোস্ট সার এর গুরুত্ব:
১) কম্পোস্ট সারের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাল দিক হল এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং জৈবিক পদ্ধতি। জৈব সার ব্যবহার করলে কৃষি রাসায়নিক যেমন সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশকের প্রয়োজন কমে যায় এবং কোনওরকম দূষণ ছাড়াই এই সার তৈরি করা সম্ভব।
২) কম্পোস্ট সারের ব্যবহারের ফলে মাটির ভৌত রাসায়নিক এবং জৈবিক ধর্ম বা চরিত্র উন্নত হয়।
৩) প্রতিনিয়ত কম্পোস্ট সার ব্যবহারে মাটিতে উপকারী অণুজীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যেগুলি বিভিন্ন উপায়ে গাছের বৃদ্ধি ও ফলনের উন্নতিতে সাহায্য করে।
৪) কম্পোস্ট সার প্রয়োগে গাছের রোগ ও পোকা-মাকড়ের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
৫) সুষম জৈব সার মাটির গুণাগুণ এবং কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং গাছের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায়।
উপসংহার:
রান্নাঘরের বর্জ্যের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্জ্যজনিত দূষণ রোধ করা যেতে পারে। এছাড়া এই বর্জ্য থেকে উৎপাদিত জৈব সার জমিতে প্রয়োগ করলে মাটির কার্যক্ষমতা বেড়ে যায়। গাছ তার সমস্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ পায় এবং উন্নত মানের ফসল ফলাতে সাহায্য করে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.