পুকুরের পরিবেশ, চারার গুণমান, মাছ মজুতের পরিমাণ ও পরিচর্যার উপর নির্ভর করে মাছ চাষের সাফল্য। কোনও কারণে পুকুরের পরিবেশের ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তন, অবিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্ন গুণগত মানের মাছের চারা সংগ্রহ, অধিক পরিমাণ চারা মজুত কিংবা পরিচর্যার অবহেলার কারণে মাছ রোগাক্রান্ত হতে পারে এবং মারা যেতে পারে। তাই পোনা মাছের রোগ প্রতিকার জরুরি। আগে ক্ষতরোগ, পাখনা ও লেজ পচা রোগ, ফুলকা পচা রোগ, ফুলকায় সাদা দাগ (গুটি) রোগ ও ড্রপসি বা উদরী রোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এবার পোনা মাছের চোখের রোগ, সাদাতুলা রোগ,হোয়াইটস্পট বা সাদা দাগ বা ইকথিওপথ্রিয়েসিস,ঘা বা আলসার, মাছের উকুন (আরগুলাস), পোকা (এরগাসিলাস) ও নোঙর যুক্ত পোকা (লারনিয়া), কৃমিঘটিত গাইরোড্যাকাটাইলোসিস ও বসন্ত রোগ বা মিকপোস্পারোডিওসিস নিয়ে লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অসীম কুমার গিরি।
রোগের নাম: চোখের রোগ।
আক্রান্ত মাছের নাম: কাতলা, সিলভার কার্প এবং কিছু জিওল মাছ।
রোগ সৃষ্টিকারক: ব্যাকটেরিয়া।
রোগের লক্ষণ:
১) প্রথমে চোখ ঘোলাটে হয় এবং পরবর্তীকালে সাদা হয়ে যায় অর্থাৎ চোখে ছানি পড়ে।
২) চোখ ফুলে বাইরের দিকে বেরিয়ে আসে।
৩) মাছ অন্ধ হয়ে যায় এবং মারা যায়।
প্রতিকার ব্যবস্থা:
১) প্রতি লিটার জলে ৮ – ১০ মিলিগ্রাম ক্লোরোমাইসিটিন গুলে সেই দ্রবণে আক্রান্ত মাছকে ৫ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে (৩ – ৪ দিন)।
২) জলকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য হেক্টর প্রতি পুকুরে ১৭৫-২০০ কেজি কলিচুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন দেওয়ার একদিন পর হেক্টর প্রতি পুকুরে (১ মিটার গভীরতার জন্য) ১ পিপিএম হারে (৯ কেজি ৭৫০ গ্রাম) পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট প্রয়োগ করতে হবে।
রোগের নাম: সাদাতুলা রোগ (স্যাপ্রোলেগনিয়াসিস)।
আক্রান্ত মাছের নাম: রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, ঘেসো রুই, পুঁটি, ল্যাটা ও চারাপোনা।
রোগ সৃষ্টিকারক: ছত্রাক।
রোগের লক্ষণ:
১) মাছকে বহন করার সময় বা জাল টানার সময় মাছের দেহে কোন ক্ষত সৃষ্টি হলে ঐ ক্ষতস্থানে সাদা সাদা সূতোর টুকরা বা রোঁয়ার মত এক প্রকার ছত্রাক বাসা বাঁধে।
২) মাছ ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩) ক্ষত বা ঘা ক্রমশঃ বাড়তে থাকে এবং মাছ মারা যায়।
প্রতিকার ব্যবস্থা:
১) প্রতি লিটার জলে ৩০ গ্রাম লবন (চারাপোনা হলে ১০ গ্রাম) মিশিয়ে আক্রান্ত মাছকে ৫–৭ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে (৩–৪ দিন)।
২) ১০ লিটার জলে ৫ গ্রাম তুঁতে মিশিয়ে ঐ দ্রবণে আক্রান্ত মাছকে ১০–১৫ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে।
৩) প্রতি লিটার জলে ৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে ঐ দ্রবণে আক্রান্ত মাছকে ৫–১০ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে।
৪) হেক্টর প্রতি পুকুরে ১৭৫-২০০ কেজি কলিচুন প্রয়োগ করতে হবে।
রোগের নাম: হোয়াইটস্পট বা সাদা দাগ বা ইকথিওপ্থ্রিয়েসিস।
আক্রান্ত মাছের নাম: রুই, কাতলা, মৃগেল ও চারাপোনা।
রোগ সৃষ্টিকারক: আদ্যপ্রাণী বা প্রোটোজোয়া।
রোগের লক্ষণ:
১) আক্রান্ত মাছের গায়ে ও পাখনায় গুটি গুটি সাদা দাগ দেখা যায়।
২) পরে দাগগুলি একটু বড় হয়ে সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ে।
৩) মাছ ছটফট করতে থাকে, পুকুর পাড়ে বা পুকুরে পুঁতেরাখা বাঁশে গা ঘষতে থকে।
৪) মাছ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে।
প্রতিকার ব্যবস্থা:
১) প্রতি লিটার জলে ৩০ গ্রাম লবন মিশিয়ে আক্রান্ত মাছকে ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে (৩-৪ দিন)।
২) ৫ লিটার জলে ১ মিলিলিটার ফরমালিনের দ্রবণে মাছকে ১০–১২ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে (২–৩ দিন)।
৩) হেক্টর প্রতি পুকুরে ১৭৫-২০০ কেজি কলিচুন প্রয়োগ করতে হবে।
রোগের নাম: ঘা বা আলসার।
আক্রান্ত মাছের নাম: রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, ঘেসো রুই, মাগুর, শিঙ্গি।
রোগ সৃষ্টিকারক: ব্যাকটেরিয়া।
রোগের লক্ষণ:
১) গায়ে ছোট বড় ঘা দেখা যায়।
২) চোখ কিছুটা বাইরে বেরিয়ে আসে।
৩) শরীর ফুলে যায়।
প্রতিকার ব্যবস্থা:
১) প্রতি লিটার জলে ৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে ঐ দ্রবণে আক্রান্ত মাছকে ৫–১০ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে।
২) আক্রান্ত মাছকে সালফারডাইজিন (১০০ এমজি প্রতি কেজি) আথবা টেরামাইসিন (৭০–৮০ এমজি প্রতি কেজি) খাবারে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
রোগের নাম: মাছের উকুন (আরগুলাস), পোকা (এরগাসিলাস) ও নোঙর যুক্ত পোকা (লারনিয়া)।
আক্রান্ত মাছের নাম: রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, ঘেসো রুই।
রোগ সৃষ্টিকারক: সন্ধিপদী পরজীবী।
রোগের লক্ষণ:
১) ছোট ছোট চ্যাপটা এক ধরনের উকুন মাছের গায়ে আটকে থেকে রক্ত শোষণ করে।
২) দ্রুত বংশ বিস্তার করে খুব তাড়াতাড়ি সমস্ত মাছকে আক্রমণ করে।
৩) মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
৪) পোকা ও নোঙর যুক্ত পোকা, মাছের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন মাথা, ফুলকা, পেট, পাখনা ইত্যাদিতে থাকতে দেখা যায়।
৫) মাছের আঁশ আলগা হয়ে যায় এবং আক্রান্ত স্থানে রক্ত দেখা যায়।
৬) মাছ ছটফট করতে থাকে, পুকুর পাড়ে বা পুকুরে পুঁতে রাখা বাঁশে গা ঘষতে থকে।
প্রতিকার ব্যবস্থা:
১) প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি লিটার জলে ৩০ গ্রাম লবন মিশিয়ে আক্রান্ত মাছকে ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে (২-৩ দিন)।
২) প্রতি হেক্টর পুকুরে (১ মিটার গভীরতার জন্য) ৫ কাজি গ্যামাক্সিন প্রয়োগ করতে হবে (সপ্তাহে ২-৩ বার)।
৩) প্রতি হেক্টর পুকুরে (১ মিটার গভীরতার জন্য) ৬০-৭৫ মিলিলিটার নোভান (Novan) প্রয়োগ করতে হবে। এতে আরগুলাস মারা গেলেও তাদের ডিম মরবে না। তাই ৪-৫ দিন পর যখন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে তখন আবার একই মাত্রায় নোভান প্রয়োগ করে পুকুর থেকে আরগুলাস নির্মূল করা সম্ভব।
রোগের নাম: কৃমিঘটিত গাইরোড্যাকা্টাইলোসিস।
আক্রান্ত মাছের নাম: রুই, কাতলা, মৃগেল ও চারাপোনা।
রোগ সৃষ্টিকারক: কৃমি (পরজীবী)।
রোগের লক্ষণ:
১) বর্ষাকালে এদের ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং মাছের ভীষণ ক্ষতি করে।
২) এরা সূক্ষ্ম হুকের সাহায্যে মাছের দেহের বাইরে এবং ফুলকায় আটকে থেকে রক্ত শোষণ করে।
৩) দেহ ও ফুলকা থেকে প্রচুর লালা বা শ্লেষ্মা জাতীয় পদার্থের ক্ষরণ হয়।
৪) আঁশ, দেহ ও ফুলকা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
৫) ফুলকায় ঘা হয় এবং মাছের শ্বাসগ্রহণে আসুবিধা হয়।
৬) মাছ ছটফট করতে থাকে, পুকুর পাড়ে বা পুকুরে পুঁতেরাখা বাঁশে গা ঘষতে থকে।
প্রতিকার ব্যবস্থা:
১) প্রতি লিটার জলে ৩০ গ্রাম লবন মিশিয়ে আক্রান্ত মাছকে ৫-৬ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে (২-৩ দিন)।
২) ৫ লিটার জলে ১ মিলিলিটার ফরমালিনের দ্রবণে মাছকে ১০-১৫ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে।
৩) হেক্টর প্রতি পুকুরে ১৭৫-২০০ কেজি কলিচুন প্রয়োগ করতে হবে।
রোগের নাম: বসন্ত রোগ বা মিক্পোস্পারোডিওসিস।
আক্রান্ত মাছের নাম: রুই, কাতলা, মৃগেল ও চারাপোনা।
রোগ সৃষ্টিকারক: আদ্যপ্রাণী বা প্রোটোজোয়া।
রোগের লক্ষণ:
১) আক্রান্ত মাছের দেহ ও ফুলকাতে আলপিনের মাথার মত সাদা সাদা গুটি দেখা যায়।
২) প্রকোপ দেশী হলে মাছের শ্বাসকষ্ট হয় এবং মাছের আঁশ আলগা হয়ে খসে পড়ে।
প্রতিকার ব্যবস্থা:
১) প্রতি লিটার জলে ২০ গ্রাম লবন মিশিয়ে আক্রান্ত মাছকে ৫ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে।
২) ৫ লিটার জলে ১ মিলিলিটার ফরমালিনের দ্রবণে মাছকে ১০ – ১৫ মিনিট ডুবিয়ে ছাড়তে হবে।
৩) হেক্টর প্রতি পুকুরে ১৭৫-২০০ কেজি কলিচুন প্রয়োগ করতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.