ফাইল ছবি
ভারতবর্ষের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ আনারস চাষে অগ্রণী রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলিতেই মূলত এই ফসলের চাষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উত্তরের জেলাগুলির মধ্যে, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারেই মূলত আনারস চাষ হয়। রাজ্যে আনারস চাষ হয় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। পড়ুন শেষ পর্ব।
ফসলের পরিচর্যা
পূর্ববর্তী পর্বে আগাছা নিয়ন্ত্রণ এবং মালচিং বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
মাটি চাপানো
আনারসের শিকড় মাটির খুব গভীরে যায় না- shallow rooted। ফল ধরার পর, গাছ অনেক সময়ই মাটিতে ঢলে পড়ে। এর ফলে, ফল তার স্বাভাবিক আকৃতি পায় না, বৃদ্ধিও আটকে যায়। জমিতে আনারস রিজ অ্যান্ড ফারো (আল এবং খাড়ি) পদ্ধতিতে লাগানো হয়। (এখন অবশ্য বিভিন্ন উদ্যান ফসলই, সেচ ও আনুষঙ্গিক পরিচর্যার সুবিধার জন্য এই পদ্ধতিতে চাষ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।) গাছ ঢলে পড়া আটকাতে, ফল ধরার পর, আলে
গাছগুলির গোড়ায় আবার মাটি চাপিয়ে বেঁধে দেওয়া জরুরি।
ফুল ফোটানো নিয়ন্ত্রণ
উত্তরবঙ্গে, জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ সপ্তাহের মধ্যে সব আনারস পেকে যায়। এর ফলে, সেই সময়টায় বাজারে আনারসের ঢল নামে। ফলে, কৃষক আনারসের যথাযথ দাম পান না। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, বিভিন্ন সময়ে চারা রোপণ করা, ফুল ফোটা এগিয়ে পিছিয়ে ফল আাসাটাকেও খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, ফলের বাড়তি দাম পাওয়া যেতে পারে। চারা লাগানোর ৩৩৫-৩৬৫ দিন পর ০.২৫ মিলি ইথরেল প্রতিলিটার জলে মিশিয়ে বা ২০ গ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে, গাছ প্রতি ৫০ মিলি করে প্রয়োগ করলে অথবা ২ গ্রাম করে ক্যালসিয়াম কার্বাইড গাছের মাঝখানে প্রয়োগ করলে সেসব গাছে ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ফল পাওয়া সম্ভব। এই সময়ে বাজারে অন্য ফল কম থাকায় আনারসের বাড়তি দাম পাওয়া যাবে। গাছে ফুল আসার ১২০ দিন পর ০.২৫ মিলি ইথরেল প্রতি লিটার জলে গুলে প্রয়োগ করলে ফলের মিষ্টতা বৃদ্ধি পায়। ১০-২০ দিন আগে ফল ও তোলার উপযুক্ত হয়ে যায়।
রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণ
ফলন্ত আনারস গাছে কীটপতঙ্গ, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ তেমন একটা হয় না। তবে মিলিবাগ বা দয়ে পোকা, মাকড়, আঁশ পোকা, থ্রিপ্স ইত্যাদির উপদ্রবে ফসলের ক্ষতি হতে পারে। একই গাছ বছরের পর বছর লাগানো থাকলে এই সব কীট-পতঙ্গের সমস্যা বাড়ে। জমি আগাছা মুক্ত রাখা, ফসল তেলার পর ভাল করে চাষ দিয়ে মাটিতে থাকা পতঙ্গের পুত্তলি নষ্ট করা, জমি আচ্ছাদনে রিফলেক্টিভ মাল্চ ব্যবহার, জৈব নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির অঙ্গ হিসেবে বন্ধু পোকা, ক্রাইসোপারলার ডিম বা কীড়া গাছ প্রতি একটা/ দুটো করে ছাড়তে পারলে ক্ষতিকারক পোকাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ফল ভাঙা ও পরবর্তী পরিচর্যা
গাছ থেকে সংগ্রহ করার পর, আনারসের গুণগত মানের খুব একটা পরিবর্তন হয় না। সুতরাং পরিণত না হওয়া পর্যন্ত আনারস গাছ থেকে তোলা উচিৎ নয়।
ফল পরিণত হওয়ার লক্ষণ:
১) ফলের খোসা হলুদ বা কমলা হলুদ এবং গায়ের চোখ গুলি অপেক্ষাকৃত মসৃণ হয়ে আসবে।
২) আনারসের চোখের গায়ের পাতলা আঁশ শুকিয়ে বাদামী রঙের হয়ে যাবে। মনে রাখা প্রয়োজন, একদিকে যেমন অপরিণত ফলের স্বাদ ও গন্ধ নিম্নমানের হয়, পরিপক্ক ফলও কিন্তু বাজারে নিয়ে যাওয়ার সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে ফল ভাঙার উপযুক্ত সময় সঠিক ভাবে নির্বাচন জরুরি।
কখন ভাঙবেন?
ক) ওজন: জাত অনুযায়ী ফলের ওজন যথাযথ হবে।
খ) রঙ: বাজারে পৌঁছনোর সময়, ফলের রঙ অর্ধেকের বেশি হলদে বা কমলা হয়ে যাবে।
গ) মিষ্টত্ব: কিউ জাতের- ১২° ব্রিক্স।কুইন জাতের-১৩° ব্রিক্স।গ) ক্রাউন বা মুকুট: সবুজ, সতেজ এবং অটুট থাকতে হবে।
ঘ) মুকুট ও ফলের দৈর্ঘের অনুপাত: ১:১.৫-২.০ হতে হবে। আনারসের ক্ষেত্রে, মুকুটের দৈর্ঘ একটিি উল্লেখ্য মান হিসেবে গণ্য করা হয়।
ফল সংগ্রহ:
গাছ থেকে সংগ্রহ করার সময়, ২ সেমি গোড়া সহ ফলগুলি কাটতে হবে। মোচড় দিয়ে ফল ভাঙলে, মোচড়ানো অংশ থেকে পচন শুরু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গাছ থেকে ফল তোলার পর, গাছের ক্ষতস্থানে ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করলে পচন আটকানো যায়।
ফল তোলার পর পরিচর্যা
ফল ঝাড়াই বাছাইয়ের সময় পচা, দাগী, ছোট, অপরিণত ফলগুলিকে বাদ দিতে হবে। ‘A’ গ্রেডের আনারসের ওজন ১.৫ কেজি এবং সঠিক মাপের মুকুট অবশ্যই থাকতে হবে। অন্যান্য গ্রেডের ফলেও ন্যূনতম এক চতুর্থাংশ মাপের মুকুট থাকা আবশ্যিক।
ফল পরিষ্কার ও ধৌতিকরণ:
রফতানির উপযুক্ত ফলগুলিকে প্রথমেই পরিষ্কার জলে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড মিশিয়ে ধুয়ে, ভাল করে শুকিয়ে নিতে হবে। আনারসের ‘সেল্ফ লাইফ’ বাড়ানোর জন্য, অনেক সময় ফলের উপর তরল মোমের প্রলেপ দেওয়া হয়, যা ৩০-৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপে শুকিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
ফলের প্যাকেজিং
বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নানা ধরনের প্যাকেজিং বাক্স বা ঝুড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে। বাক্সে ফলগুলিকে খাড়া করে সাজালে, পরিবহন কালে ঘষা লাগার সম্ভাবনা থাকে না। ফল সহ বাক্সের ওজন ৯-১৮ কেজির মধ্যে থাকবে।
প্রাক-শীতলীকরণ
ফল সংগ্রহের ৮-১০ ঘণ্টার মধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আধ-পাকা ফলের ক্ষেত্রে ৭-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, পরিণত ফলের ক্ষেত্রে ১০-১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই শীতলীকরণ করতে হবে। বেশি ঠান্ডায় ফলে চিলিং ইনজুরি হতে পারে। এই শীতলীকরণের সময় আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ হবে ৮৫-৯০%। এই অবস্থায় কোল্ড স্টোরেজে বেশ কিছুদিন আনারস সংরক্ষণ করা সম্ভব।
(বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল ও বাগিচা পরিচর্যা বিভাগ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সুপারিশ অনুযায়ী এএপিপি কর্তৃক প্রকাশিত।)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.