Advertisement
Advertisement

Breaking News

Onion

জোগানে ঘাটতি রুখতে পিঁয়াজের বীজ উৎপাদনে কামাল

পিঁয়াজ উৎপাদনে ভারতের স্থান দ্বিতীয়।

Here is the procedure of onion seeds cultivation
Published by: Sayani Sen
  • Posted:July 17, 2024 4:57 pm
  • Updated:July 17, 2024 4:58 pm

আলু আর পিঁয়াজের দাম নিয়ে প্রতি বছর যে হইচই লক্ষ্য করা যায় তা আমাদের রাজ্যের এই সব ফসল চাষের মূল সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। এইসব ফসলের বীজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। তা শীতকালীন ফসল হোক বা বর্ষাকালীন পেঁয়াজ হোক। তাই বীজ উৎপাদনের প্রযুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেই পিঁয়াজের বাজার অনেক নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। সারা বছর ধরে চাষবাসের মাধ্যমে বাজারে ফলনের জোগান ঠিক রাখে। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবজি বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. তপনকুমার মাইতি।

দৈনন্দিন জীবনে পেঁয়াজ একটি মূল্যবান সবজি। দেশে ও বিদেশে পেঁয়াজ কাঁচা, সবুজপাতা ও কলি অন্যান্য সবজির সঙ্গে রান্না করে ও শুকনো করে গুঁড়ো অবস্থায় এর ব্যবহার আছে। এছাড়া পিঁয়াজের নানারকম ওষধি গুণও বর্তমান। পিঁয়াজের কন্দ ফসফরাস, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। শ্বেতসারে ভরপুর। এতে ভাল পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিন
রয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে পিঁয়াজ উৎপাদনে ভারতের স্থান দ্বিতীয়। দেশের আভ্যন্তরীণ বাজার ছাড়াও বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পিঁয়াজের একটি বিশেষ স্থান আছে।

Advertisement

বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি
বীজ উৎপাদনের নিরিখে, পেঁয়াজ একটি দ্বি-বর্ষজীবী উদ্ভিদ। দেশে যে সমস্ত জাত সমতল ভূমিতে হয়, সেগুলির বীজ উৎপাদন সমতলে করা যায়। এই বীজ উৎপাদন করতে গেলে যে বিষয়গুলি সর্ম্পকে অবশ্যই জানতে হবে তা হল
১) বীজ থেকে বীজ উৎপাদন পদ্ধতি
বীজ থেকে উৎপাদনের এই পদ্ধতিকে ইন-সিটু (In situ) পদ্ধতি বলে। এই পদ্ধতিতে পিঁয়াজের কন্দ লাগানোর পরে একই জমিতে ফুল ও বীজ তৈরি হয়। বীজতলাতে বীজ বোনা হয় জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি থেকে আষাঢ়ের শেষ পর্যন্ত এবং চারা রোপণ করা হয় আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিনের শেষ পর্যন্ত। পিঁয়াজের ফুল বা কলি বেরুতে শুরু হয় মাঘ-ফাল্গুণে এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি বীজ তৈরি হয়।
সুবিধা:
* কম খরচে উৎপাদন প্রযুক্তি।
* জলদি পরিণত হয়।
* বীজের জন্য কন্দ সংরক্ষণের প্রয়োজন হয় না।
অসুবিধা:
* যেহেতু কন্দ নির্বাচন করা হয় না, সে জন্য উৎপাদিত বীজের গুণগত মান ঠিক থাকে না।
* বীজ উৎপাদন কম হয়।
২) কন্দ থেকে বীজ উৎপাদন পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে কন্দ তুলে নির্বাচিত কন্দগুলি পুনরায় জমিতে লাগানো হয়। দুটি পদ্ধতিতেই এই বীজ উৎপাদন হয়-
বার্ষিক পদ্ধতি (Annual method):
বীজ বোনা জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি থেকে আষাঢ়ের শেষ পর্যন্ত্য। চারা রোপন আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত্য। কন্দ তৈরি হয় কার্তিকের মাঝামাঝি থেকে পৌষের মাঝামাঝি পর্যন্ত। পিঁয়াজের কন্দ তোলার পরে কয়েকদিন শুকনো করে নিতে হবে। শুকনো নির্বাচিত কন্দগুলি মাঠ থেকে কন্দ তোলার ১৫ দিন পরে মূল জমিতে লাগানো হয়। কন্দ লাগানো হয় অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে। কলি বা ফুল এসে যায় ফাল্গুণ মাসে। জ্যৈষ্ঠ মাসে বীজ তৈরি হয়ে যায়। যেহেতু এই পদ্ধতিতে এক বছর সময় লাগে তাই এটি বার্ষিক পদ্ধতি। বর্ষার মরসুমের পিঁয়াজের জাতগুলি যেমন এগ্রিফাউন্ড ডার্ক রেড, এন-৫৩, বসন্ত ৭৮০, আর্কা কল্যাণ প্রভৃতি সাধারণত এই পদ্ধতিতে বীজ উৎপাদিত হয়।
দ্বি-বার্ষিক পদ্ধতি (Biennial method):
এগ্রিফাউন্ড লাইট রেড, পুসা রেড, এন-২-৪-১, সুখসাগর এবং অন্যান্য রবি মরসুমের জাতগুলির বীজ এই পদ্ধতিতে তৈরি হয়। পিঁয়াজের কন্দ তৈরির জন্য প্রথমে চারা তৈরি ও রোপণ করা হয় সময়ানুযায়ী। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি থেকে বৈশাখের শেষে কন্দ তোলা হয়। কন্দগুলি ভাল করে শুকিয়ে নিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। কন্দগুলি কাটাকাটি ও রোগবিহীন হওয়া বাঞ্ছনীয়। কার্তিকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়। কন্দগুলি ভাল ভাবে তৈরি মূল জমিতে লাগানোর আগে কন্দগুলি নির্বাচিত করা হয় নির্দিষ্ট আকারের নিরিখে। যেহেতু এই পদ্ধতিতে প্রায় দেড় বছর সময় লাগে তাই এটি দ্বি-বার্ষিক পদ্ধতি।
সুবিধা:
* প্রকৃত কন্দ নির্বাচিত হয় বলে উচ্চমানের বীজ তৈরি হয়।
* বেশি পরিমাণ বীজ উৎপাদন হয়।
অসুবিধা:
* এই পদ্ধতিতে সময় বেশি লাগে।
* বীজ উৎপাদন খরচ বেশি।

Advertisement

[আরও পড়ুন: লেমন গ্রাস চাষে বাজিমাত, ২ টাকা বিনিয়োগে হোন লাখপতি!]

জাত:
রাজ্যে সাধারণভাবে রবি ও বর্ষার মরসুমে পিঁয়াজের চাষ হয়। রবি মরসুমে সুখসাগর জাতের চাষই মূলত হয়ে থাকে। বর্ষার মরসুমে পিঁয়াজের চাষ ইদানীং সময়ে শুরু হয়েছে। এই সময়ের উপযোগী জাতগুলি হল, এগ্রিফাউন্ড ডার্ক রেড, এন-৫৩, বসন্ত ৭৮০, আর্কা কল্যাণ প্রভৃতি।
আবহাওয়া:
পিঁয়াজের বীজ উৎপাদন বিভিন্ন আবহাওয়াতে হতে দেখা যায়। বীজ উৎপাদনের জন্য তাপমাত্রা দিনের সূর্যালোক খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খুব বেশি ঠান্ডা বা গরম পড়ে না এবং বেশিমাত্রায় বৃষ্টি হয় না এইসব এলাকা বীজ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযুক্ত। গাছের বৃদ্ধির পরের দিকে ১০-১২ ঘণ্টা দিনের আলো ও ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং গড় আর্দ্রতা ৭০% থাকলে পিঁয়াজের কন্দ ভাল বাড়ে ও ফুল এবং বীজ গঠিত হয়।
মাটি:
পলি ও দোঁয়াশ মাটি পেঁয়াজ চাষ ও বীজ উৎপাদনের পক্ষে অনুকুল, তবে দোঁয়াশ মাটি পিঁয়াজের বীজ উৎপাদনের জন্য খুবই ভাল। এঁটেল মাটিতে বেশি পরিমাণ জৈব সার দিয়ে ভাল ফলন পাওয়া যায়। মাটির অম্লত্ব ৫.৫-৫.৮ এর মধ্যে থাকলে ফলন বেশি হয়, তবে অম্লত্বের মান ৫.৫ এর নীচে থাকলে চুন প্রয়োগ করা খুবই জরুরি। সাধারণত ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে আগছা বলেছেন, মাটি ঝুরঝুরে ও জমি সমান করে কন্দ বসানো হয়। প্রয়োজনমত সেচ ও জলনিকাশের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
কন্দ নির্বাচন ও পরিমাণ:
সুস্থ, পরিপক্ক ও মাঝারী থেকে বড় আকারের কন্দ নির্বাচন করা হয়। সাধারণত মাঝারি আকারের কন্দ (৪.৫ সেমি বড় পেঁয়াজ, ২.৫-৩ সেমি ছোট পেঁয়াজ) বেশি ফলনের জন্য বেছে নেওয়া হয়।খুব বড় আকারের কন্দ: ৬-৭ কুইন্ট্যাল প্রতি বিঘাবড় আকারের কন্দ : ২.৫-৩.৫ কুইন্ট্যাল প্রতি বিঘামাঝারি আকারের কন্দ: ১.৫-২ কুইন্ট্যাল প্রতি বিঘা।
কন্দ শোধন:
কন্দ বাহিত রোগ নিরাময়ে কন্দ শোধন খুবই জরুরি। মূল জমিতে কন্দ লাগানোর আগে কন্দগুলি ট্রাইকোডারমা ভিরিডি ৫ গ্রাম হারে প্রতি কেজি কন্দের সাথে ভালভাবে মাখিয়ে বা ম্যাঙ্কোজেব ২.৫ গ্রাম হারে প্রতি লিটার জলে ১-২ মিনিট ডুবিয়ে রেখে কন্দ শোধন করা হয়। শোধনের আগে কন্দের উপরের অংশের ১/৪ ভাগ কেটে বাদ দিয়ে শোধন করা হয়। এতে অনেকগুলি গাছ বের হয় এবং পরে অনেকগুলি কলি ও হয়।
কন্দ লাগানোর সময়:
রবি মরশুমের জাতগুলি কার্তিকের শেষ সপ্তাহ থেকে অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত লাগানোর উপযুক্ত সময়। বর্ষার মরসুমের জাতগুলি অগ্রহায়ন মাসের মাঝামাঝি থেকে পৌষ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত লাগানোর উপযুক্ত সময়।
কন্দ লাগানোর দূরত্ব:
সারি থেকে সারি: ৪৫ সেমি (সাধারণ এঁটেল বা দোঁয়াশ মাটির জন্য)।
কন্দ থেকে কন্দ: ৩০ সেমি।
সারি থেকে সারি: ৩০ সেমি
(বেলে মাটির জন্য)।
কন্দ থেকে কন্দ: ৩০ সেমি।
অন্তরণ দূরত্ব:
যেহেতু পেঁয়াজ একটি ইতর পরাগযোগী (৯৩%) ফসল তাই বিভিন্ন জাতের বীজ উৎপাদনে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অন্তরণ দূরত্ব বজায় রাখা খুবই জরুরি। আধারীয় ও শংসিত বীজ উৎপাদনের জন্য দুটি জাতের মধ্যে যথাক্রমে ১০০০ ও ৫০০ মিটার দূরত্ব রাখতে হবে। মৌমাছি পরাগযোগে প্রধান ভূমিকা নিয়ে থাকে। উন্নতমানের বীজের জন্য জমিতে ভাল সংখ্যায় মৌমাছি থাকা দরকার। পরাগমিলনের জন্য নীচের বিষয়গুলিতে নজর দেওয়া খুবই জরুরি।
* মৌমাছির বাক্স অবশ্যই জমিতে রাখতে হবে।
* ফুল ও বীজ ধরার সময় জমিতে পর্যাপ্ত রস যেন থাকে।
* ফুল ধরলে নিরাপদ কীটনাশক স্প্রে করা দরকার।
* বেশি বাতাস বইলে মৌমাছি ফুলের উপর বসে না তাই বাতাস আটকাতে মাঠের চারপাশে গাছ লাগানো দরকার।উচ্চ গুণমান সম্পন্ন বীজের জন্য রোগ লাগা, আলাদা জাত ও অবাঞ্ছিত উদ্ভিদ গাছে ফুল আসার আগেই তুলে ফেলতে হবে। যে সমস্ত গাছে খুব আগে বা পরে ফুল আসে, সেগুলি ও তুলে ফেলতে হবে।
সার প্রয়োগ:
জমি তৈরির সময় বিঘা প্রতি ১৩-১৫ কুইন্টাল গোবর সার বা খামার পচা সার ভালভাবে মিশিয়ে ২-৩ টি চাষ দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। মূল সার হিসেবে বিঘা প্রতি ৮-১০ কেজি নাইট্রোজেন, ৮-১০ কেজি ফসফরাস, ৭-৮ কেজি পটাসিয়াম ও ৪-৫ কেজি সালফার দিতে হবে। চাপান সার হিসেবে কন্দ লাগানোর ৪৫-৬০ দিন পরে বিঘা প্রতি ৮-১০ কেজি নাইট্রোজেন দিতে হবে। পেঁয়াজ বীজের উচ্চ ফলন ও উন্নত গুনমানের জন্য অণুখাদ্যের প্রয়োগ খুবই জরুরি। এরজন্য ০.২৫ শতাংশ জিঙ্ক সালফেট (২.৫ গ্রাম জিঙ্ক সালফেট এবং ১.২৫ গ্রাম চুন প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে কন্দ লাগানোর ৩০ এবং ৪৫ দিন পর স্প্রে) ও ০.২ শতাংশ বোরাক্স (২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে জলে মিশিয়ে কন্দ লাগানোর ৫৫ এবং ৭০ দিন পর স্প্রে) প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ও অন্তবর্তী পরিচর্যা:
মাটির ধরণ ও মরশুম অনুযায়ী ৭-১০ দিন অন্তর সেচ দেওয়া দরকার। ফুল বা বীজ ধরার সময় জমিতে পর্যাপ্ত রস যেন থাকে। চারা লাগানোর দুমাস পরে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে যাতে গাছ শুয়ে না পড়ে। সময়মত আগাছা নিয়ন্ত্রণ দরকার।
ফসল তোলা:
কন্দ লাগানোর ৫-৫.৫ মাস পর বীজ তোলার উপযুক্ত হয়ে যায়। এইসময় ফলগুলি ভালভাবে পেকে যায় এবং কালো বীজ দেখা যায়। প্রতিটি দণ্ডের মাথায় ৫-১০ শতাংশ শুঁটির বীজ কালো দেখা গেলে ফসল কাটা উচিৎ। সমস্ত ফল একেবারে পাকে না বলে, ২-৩ বারে বীজ তোলা হয়। ডাঁটার ১০-১৫ সেমি মত অংশ সহ ফলগুলি তুলে গাদা করে শুকিয়ে নেওয়া হয়। গাদার উচ্চতা ১৫ সেমির বেশি যেন না হয় এবং প্রতিদিন গাদাকে উল্টে পাল্টে দেওয়া হয়। বীজসহ ফলগুলিকে ভালভাবে শুকনো করে ঝাড়াই মাড়াই করতে হবে। হাত দিয়ে ঘসে বা বলদ দিয়ে মাড়িয়ে বীজ বের করে নেওয়া হয়।
ফলন:
বিঘা প্রতি বীজের গড় ফলন ৮০-১০০ কেজি।
বীজ সংরক্ষণ:
পিঁয়াজের বীজ ২-৩ দিন রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়, তারপর সেগুলি ঘরে রেখে ঠান্ডা করে বায়ুরুদ্ধ পাত্রে রাখা হয়। শুকনো বীজে জলের পরিমাণ ৬-৮ শতাংশ রাখা হয়।

[আরও পড়ুন: বাংলার মাটিতেই ফলছে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের আম! বিদেশি গাছের চাহিদা তুঙ্গে]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ