আধুনিক প্রযুক্তি সহযোগে গঠিত নির্ভুল কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থারই নাম হল Precision Farming বা যথার্থ কৃষি। স্থানভিত্তিক পরিচালন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে (দূরবর্তী সংবেদন বা Remote sensing ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা বা GIS এবং বিশ্বজনীন অবস্থান নির্ণায়ক ব্যবস্থা বা GPS) একটি স্থানিক পরিবর্তনশীলতার নিয়মিত মূল্যায়ন করা হয়। এবং সেইমতো কৃষি জমিটির মধ্যেকার ফসল এবং মাটির যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত করা যায়, তা চিহ্নিত করে মানচিত্রে চিত্রাঙ্কিত করা হয় এবং সেই অনুযায়ী কী রূপ পরিচালন ক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে, তা ধার্য করা হয়। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সৌরভ রায়।
প্রথম পর্বের পর (প্রথম পর্ব)
নির্ভুল কৃষি হল এমন এক সমন্বিত ফসল পরিচালন ব্যবস্থা, যা একটি নির্দিষ্ট কৃষিজমিতে স্বল্প পরিসর স্থানে ফসলের সঠিক প্রয়োজন বুঝে সঠিক মাত্রায় এবং সঠিক পরিমাণে ইনপুট জোগান দেওয়ার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনব্যবস্থায় নির্ভুলতা নিয়ে আসে। কৃষি উৎপাদনব্যবস্থায় এই নির্ভুলতা নিয়ে আসার লক্ষ্যটা নতুন নয়, কিন্তু নতুন প্রযুক্তিগুলো এখন আগের তুলনায় সহজলভ্য হওয়ার দরুন Precision Farming-এর ধারণাটি বাস্তবে রূপান্তরিত করা সহজ হয়েছে। Precision Farming আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় এমন এক ব্যবস্থাপনা দর্শন বা অভিগমন, যার সুনির্দিষ্ট এবং নির্ধারিত কোষে প্রশমিত প্রথামতো নেই। Precision Farming চিহ্নিত করে কিছু সংকটপূর্ণ কারণ বা ক্রিটিক্যাল ফ্যাক্টরসকে যেখানে উৎপাদন কিছু নিয়ন্ত্রণযোগ্য উপাদান দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে এবং এটি সহজাত ও স্বকীয় স্থানিক পরিবর্তনশীলকে নির্ধারণ করে। আধুনিক প্রযুক্তি সহযোগে গঠিত নির্ভুল কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থারই নাম হল Precision Farming। স্থানভিত্তিক পরিচালন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে (দূরবর্তী সংবেদন বা Remote sensing ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা বা GIS এবং বিশ্বজনীন অবস্থান নির্ণায়ক ব্যবস্থা বা GPS) একটি স্থানিক পরিবর্তনশীলতার নিয়মিত মূল্যায়ন করা হয়। এবং সেইমতো কৃষি জমিটির মধ্যেকার ফসল এবং মাটির যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত করা যায়, তা চিহ্নিত করে মানচিত্রে চিত্রাঙ্কিত করা হয় এবং সেই অনুযায়ী কী রূপ পরিচালন ক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে, তা ধার্য করা হয়।
তাই, যথার্থ কৃষির ধারণা বাস্তবায়নের জন্য কিছু বিশেষ সরঞ্জাম এবং কিছু বৈশিষ্ট্যসূচক সম্পদ প্রয়োজন যা কি না ফসলের বৃদ্ধি এবং মাটির বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত অন্তর্নিহিত স্থানিক পরিবর্তনশীলতাকে চিহ্নিতকরণে সক্ষম হবে এবং তার মাধ্যমে আমরা কোনও কৃষিজমির স্থানভিত্তিক সবচেয়ে উপযুক্ত কৃষি পরিচালনা কৌশল অনুধাবনে সমর্থ হব। উৎপাদনশীল দক্ষতার সম্ভাব্য পদক্ষেপ পরিবর্তনের দিকগুলোকে উপস্থাপন করে যথার্থ কৃষি। ভারতীয় কৃষিকাজের প্রেক্ষাপটে Precision Farming-এর সবচেয়ে উপযুক্ত সংজ্ঞা হল–অধিক টেকসই উৎপাদনশীলতা, ফসলের লাভজনকতা ও উৎকর্ষ প্রবর্ধনের উদ্দেশ্যে মাটি, জলবায়ু ও ফসলের প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষি সরঞ্জাম এবং ইনপুটগুলোর যথাযথ ও সম্পূর্ণ নির্ভুল প্রয়োগ বা ব্যবহার। কৃষি ইনপুটের উত্তরোত্তর দাম বৃদ্ধি এবং কৃষিজাত পণ্যসামগ্রীর নিয়মিত দাম হ্রাসের এই সময়ে যখন কৃষক সমাজ কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং ব্যয় সংকোচনের নতুন পথ খুঁজে চলেছে ঠিক তখন Precision Farming এর মতো কৃষিব্যবস্থা গতানুগতিক কৃষির টেকসই বিকল্প হিসাবে উৎপাদনশীতা ও লাভ বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে, এ আশা করাই যায়।
Precision Farming-এর প্রয়োজনীয়তা: Precision Farming-এর আবশ্যকতা বা প্রয়োজনীয়তা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে খুবই প্রাসঙ্গিক। অন্যান্য কৃষি সরঞ্জামের পাশাপাশি পর্যাপ্ত ও পরিমিত কৃষিজ সম্পদ (যেমন জল, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, রোগনাশক এবং আগাছানাশকের) এর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে Precision Farming অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত, দুই দিকেই সুযোগ—সুবিধা লাভে সাহায্য করে। আনুমানিক গড় শর্ত কিংবা hypothetical average condition-এর উপর ভিত্তি করে সমগ্র কৃষিজমিকে পরিচালনার যে ব্যবস্থা গতানুগতিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় গৃহীত হয়, বাস্তবে সেই পন্থার কোনও অস্তিত্বই নেই। কিন্তু যথার্থ কৃষি ব্যবস্থা আনুমানিক গড় শর্তাবলির ব্যবহার ব্যতিরেকে সমগ্র কৃষিজমির স্থানভিত্তিক প্রভেদকে প্রাধান্য দেয় এবং সেইমতো কৃষি ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রিত করে। যথার্থ কৃষি তথ্য সংগ্রহ এবং তথ্য বিশ্লেষণকে স্বয়ংক্রিয় এবং সহজাত করে তোলার সম্ভাবনা প্রদান করে। এটি পরিচালনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুমতি দেয় এবং তা বৃহত্তর কোনও কৃষিক্ষেত্রের আওতাভুক্ত ছোট এলাকায় দ্রুত প্রয়োগের মাধ্যমে সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করে।
Precision Farming-এর উপাদানসমূহ: ফসলের উৎপাদনশীলতা নির্ধারণকারী উপাদানসমূহ যেমন মাটির অম্লতা বা মৌলিকত্ব, মাটিতে পুষ্টির অবস্থা, রোগপোকার উপদ্রব, ফলনের হার ইত্যাদির উপর নির্ভর করে যথার্থ কৃষি ব্যবস্থায় বৃহত্তর কোনও কৃষিক্ষেত্রকে অনেকগুলো পরিচালন অঞ্চল (management zones) অথবা গ্রিডে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেকটি পরিচালন অঞ্চলের প্রয়োজন অনুসারে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং পরিচালন অঞ্চলগুলোতে কৃষি ইনপুটগুলো সঠিক পরিমাণ ও মাত্রায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে যথার্থ কৃষি সরঞ্জাম যেমন জিআইএস, জিপিএস প্রভৃতি কাজে লাগানো হয়। অবস্থান নির্ণায়ক ব্যবস্থা বা জিপিএম প্রযুক্তির সহযোগিতায় সঠিক অবস্থান নির্ধারণ করা সহজ হয় এবং সেইমতো সঠিক অবস্থানে আধুনিক কৃষি সরঞ্জামের সাহাযে্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়। এর জন্য একজন কৃষকের ট্রাক্টরে জিপিএম গ্রাহক বা receiver স্থাপন করা বাধ্যতামূলক। এর মাধ্যমে তিনি সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারবেন যে, ঠিক কোথায় রাসায়নিক রোগপেকা নাশক প্রয়োগ করতে হবে। মানচিত্র গঠনের মাধ্যমে তিনি ফসলের ফলন নিয়ন্ত্রণেও নজর দিতে পারবেন। মানচিত্র বা ম্যাপে বেশি এবং কম উৎপাদনস্থলগুলো চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে তিনি পরিচালনাব্যবস্থা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাবলম্বী হবেন।
Precision Farming-এর প্রযুক্তিসমূহ
১) বিশ্বজনীন অবস্থান-নির্ণায়ক ব্যবস্থা বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম: বিশ্বজনীন অবস্থান নির্ণায়ক ব্যবস্থা, যাকে মূল ইংরেজিতে Global Positioning System ও সংক্ষেপে GPS নামে ডাকা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক সাতের দশকের শুরুর দিকে উদ্ভাবিত একটি প্রযুক্তি এটি। প্রথম দিকে এর প্রয়োগ ছিল সামরিক। পরে জনসাধারণের নিমিত্তে এর ব্যবহার উন্মুক্ত করা হয়। এটি একটি কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থা। যে কোনও আবহাওয়ায় পৃথিবীর যে কোনও চলমান অবস্থান আর সময়ের তথ্য সরবরাহ করাটা এর প্রধান কাজ। এটি এক ধরনের একমুখী ব্যবস্থা, কারণ ব্যবহারকারীগণ উপগ্রহ প্রেরিত সংকেত শুধুমাত্র গ্রহণ করতে পারে। বিভিন্ন স্যাটেলাইট থেকে প্রেরিত বিশেষ তথ্য যে কোনও নির্দিষ্ট GPS রিসিভার গ্রহণ করে গাণিতিক ও জ্যামিতিক হিসাবের মাধ্যমে ডিজিটাল কোনও বস্তুর বর্তমান সঠিক অবস্থান নির্ধারণ করে। এই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে একজন প্রগতিশীল কৃষক তার কৃষিক্ষেত্রের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করতে পারেন এবং কর্মক্ষমতার মানদণ্ড এবং পূর্বের ইনপুট ব্যবহারের মাত্রা, এই দুইয়ের উপর ভিত্তি করে প্রত্যেক পরিচালন অঞ্চলে প্রয়োজনমতো রাসায়নিক এবং কীটনাশক প্রয়োগে সক্ষম হন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.